অধিকার

অধিকার

কালের খেয়া

মোহিত কামাল

2024-12-26

বান্ধবী তাসনিম তুমুকে নিয়েই বেরিয়েছে পুষ্প। সায়েন্স ল্যাবের কাছে বিশাল জ্যাম। চোখ গেল সিটি কলেজের উল্টোদিকে মিরপুর সড়কে। এখান থেকে একটা গলি পশ্চিমে ঢুকে গেছে ধানমন্ডি ৩ নম্বর রোড হয়ে, আরেকটা পূর্বদিকে গেছে গ্রিন রোডের মাথায় সায়েন্স ল্যাবে ঢোকার পশ্চিম গেট বরাবর। চতুর্মুখী এই ক্রসিংয়ের দিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে বুক ধড়ফড় করা শুরু হয়ে গেল। মনে হলো এক সহযোদ্ধা রক্তাক্ত হয়ে এখানে পড়ে আছে, লুটিয়ে পড়ার আগে হাত বাড়াচ্ছে। বাঁচার আশায় সহযোগিতা চাচ্ছে। কেউ তার দিকে এগিয়ে গেলেই ফায়ারিংয়ের আওয়াজ। জীবন্ত দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে ওঠায়, জুলাইয়ের ওই সময় সে ছিল কাছাকাছি, প্রচণ্ডভাবে ঝাঁকি খেল শরীর। একজন উদ্ধার করার জন্য একবার ছুটে যাচ্ছিল তার দিকে। সাউন্ড গ্রেনেডের ভয়ংকর আওয়াজ শুনে পিছিয়ে এলো। কেউ ছেলেটার দিকে যেতে পারছে না। গেলেই ফায়ারিং। কী ভয়ংকর দৃশ্য! এখন চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে জীবন্ত দৃশ্যটা। কেঁপে কেঁপে উঠছে শরীর। কান্নাও পাচ্ছে। 
‘তুই অসুস্থবোধ করছিস?’ প্রশ্ন করল তুমু। 
‘মনে হলো সহযোদ্ধার পিচঢালা রক্ত লাল চোখ তুলে তাকিয়ে আছে! মনে হলো রক্তচোখ আমাকে বলছে, ভুলে যেয়ো না আমাদের। আমাদের উদ্দেশ্য যেন সফল হয়। রক্তঝরা দেশের পরিবর্তন যেন সফল হয়। নিজেদের সংঘবদ্ধ রেখো। শক্ত থেকো সবাই। তোমরা যেন ব্যর্থ না-হও, খেয়াল রেখো।’ 
কাঁপুনি থেমে গেল। তবে এখনও সে খামচে ধরে আছে তুমুর হাত। তুমুর স্পর্শ অনুভব করতে গিয়ে বুঝল ভালো বন্ধু সব সময় পাশে দরকার। একাকিত্বের চেয়ে বন্ধু-সঙ্গ ভালো।  
হঠাৎ মনের ভেতর জেগে উঠল ভাবনা ঢেউ– ‘ঠিক ভেবেছ, পুষ্প।’
গণঅভ্যুত্থানে শহীদ, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র ফারহানও সঙ্গে আছে। নিহত হওয়ার পরও সে পুষ্পর মস্তিষ্কে আসন গেড়ে বসে আছে। সে-ই তার মনে ভাবনা-তরঙ্গ পাঠিয়ে দিয়েছে। 
সড়কও সচল হয়ে গেছে। সব ধরনের গাড়ি ছোটার চেষ্টা করে হর্ন বাজাচ্ছে। বিকট শব্দ আর যানজটের অসহনীয় অবস্থায়ও একাকিত্ব জেগে উঠল। অথচ শরীরের সঙ্গে শরীর ঘেঁষেই বসে আছে তারা অটোতে। তুমু হাতও ধরে আছে। দেখল একটা বড় ট্রাকলরি হঠাৎ সায়েন্স ল্যাবের দিকে ঘোরাতে গিয়ে পুরো সড়ক ব্লক করে দিয়েছে। কোনো দিক থেকে আর কোনো গাড়ি চলছে না। তারা রওনা হয়েছিল বাংলা একাডেমির দিকে। বিজয় বইমেলা দেখার আশায়। উদ্বোধনের নির্ধারিত সময়ের চেয়ে প্রায় ৪৫ মিনিট দেরি হয়ে গেছে। তবু জ্যাম! অস্বস্তি জেগে উঠল। ফারহান ভেতর থেকে বলে উঠল, ‘সবকিছু সহজে পাওয়া যাবে না। প্রতিটা ক্ষেত্রে জয়ের পরে বাধা আসবে। জয় ধরে রাখা আরও জটিল। অদেখা বা গোপনীয় বাধা দেখার আগেই বিপদ ঘটিয়ে দেয়।’
‘গুপ্তহামলার কথা বলছ?’
‘গুপ্তহামলা ডেঞ্জারাস। সেটা মোকাবিলার জন্যও সতর্ক থাকতে হবে। এখন তোমার সামনে যা দেখছ তার জন্য প্রয়োজন ধৈর্য। অবসাদ দূর করে সতেজ থাকতে হবে।’
‘কীভাবে সতেজ থাকব? রাস্তায় গাড়ির টায়ার বার্স্ট হলেও মনে হয় ফায়ার হচ্ছে। চট করে মনে হয় জনস্রোতের মধ্যে কেউ কেউ লুটিয়ে পড়ছে। জুলাইয়ের সেই সময়ের ঘটনা এই সময়ের চলমান জীবনে হানা দিচ্ছে। শোয়ার সময়ও কখনও কখনও গুলির আওয়াজ শুনতে পাই।’
‘তোমাদের মন জখম হয়েছে। ট্রমা মনে স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছে। রক্তাক্ত দেহ দেখা যায়। রক্তাক্ত মন দেখা যায় না’ –আচমকা অনুভবের ভেতর ঢুকে গিয়ে বললেন রবিকবি। 
‘ও। তুমিও এসেছ কবি!’ বলল পুষ্প।
‘আমি তো আছি। তোমার মস্তিষ্কের স্নায়ুঅরণ্যে আছি। তুমিই তো আমার গান শুনতে শুনতে আমাকে তোমার ব্রেইনে স্থান দিয়েছ। তোমার মন খারাপ আর উৎকণ্ঠার সময় হাজির হব না তোমার সচেতন বোধের জগতে?’
‘আমি তো কেবল আমাকে নিয়ে ভাবি না। সেদিন হাসপাতালে গিয়েছিলাম আহতদের দেখতে। আন্দোলনে চোখ-হারানো রোহান আর ইমরান প্রশ্ন করল, “চোখে দেখতে পাব না কোনো দিন?” ওদের প্রশ্নের জবাব দিতে পারিনি। বুকটা হাহাকার করে উঠেছে। মাসুম বাচ্চারা অল্প বয়সে চোখ হারিয়ে পরিবারকেও সমুদ্রসমান হাহাকারে ডুবিয়ে দিয়েছে। বুক ভেঙে যায়। কী করব বল?’
‘ধৈর্য! ধৈর্য! ধৈর্য! আপাতত আর বলার কিছু নেই। চিকিৎসকরা কি তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছে না? করছে। বাকিটা ওপরওয়ালার হাতে ছেড়ে দাও।’
‘পরামর্শ শুনতে ভালো লাগছে না। কেবল মনে পড়ছে আরও কয়েকজনের বুক চিরে-যাওয়া কথা! চিকিৎসা নিয়ে উদ্বেগ তো আছেই, সামাজিক নিরাপত্তা নিয়েও তারা ভয়ে। ভবিষ্যতে চাকরি-বাকরি হবে কি না– এ নিয়েও টেনশনে ভুগছে, কেউ কেউ বিষাদ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।’
গণঅভ্যুত্থানে শত শত আহত হাসপাতালে হাসপাতালে চূড়ান্ত মানসিক সংকটে দিন কাটাচ্ছে। এসব অনুভব করে ভেঙে যাচ্ছে। তবু কথা বলেই যাচ্ছে পুষ্প– ‘আরেক দিন খবর পেলাম একজনের মাথার মধ্যে অসংখ্য ছররা পিলেট ঢুকে আছে। এসব বের করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন বিদেশে নিয়েও লাভ নেই। তার পেইন হচ্ছে। পেইনকিলার খেয়ে খেয়ে সে আরও বিষাদে ডুবে যাচ্ছে। আত্মহত্যারও চিন্তা করছে! আমরা কত অসহায় বুঝতে পারছ!’
ট্রাকলরিটি অবশেষে ঘোরাতে পেরেছে। যানজট খুলে গেছে। গাড়ি ছুটছে, বেপরোয়া হয়ে উঠছে চালকরা। বিশৃঙ্খলভাবে ছুটলে কি শৃঙ্খলা আসবে? দেশের কি শৃঙ্খলা আসবে! হঠাৎ মনে পড়ে গেল সিরিয়ার কথা। সেখানে বাশার আল-আসাদের পতনের পর স্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হয়েছিল। হঠাৎ ইসরালের বেপরোয় হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে গুরুত্বপূর্ণ সব সামরিক স্থাপনা– সিরিয়ার যুদ্ধবিমান, যুদ্ধজাহাজ, হেলিকপ্টার, ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া যান, ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন। জয়ীরাও বিশৃঙ্খল হয়ে যাচ্ছে। এই আক্রমণ মোকাবিলার তাদের প্রস্তুতি ছিল বলে মনে হয় না। পরিকল্পনা থাকা উচিত ছিল। তার কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না। কিছু বোঝার আগেই বিদ্রোহী-জয়ীদের কোমর ভেঙে দিয়েছে ইসরায়েল। আসাদবিরোধী আন্দোলনের বিজয়ীদের ভিত দুর্বল করাই হয়তো মূল উদ্দেশ্য।
‘ঠিকই ভাবছ, পুষ্প।’ বললেন রবিকবি। আরও বললেন, ‘তোমার ভাবনায় আমি গৌরব বোধ করছি
‘কেন?’
‘তুমি আমার পাঠক, আমার গানের শ্রোতা। আমার আসন হয়েছে তোমার মাথায়! গৌরববোধ করব না?’
‘আচ্ছা। প্রশংসা করতে হবে না।’
‘প্রশংসা নয়, তোমার ভাবনার অতলের ভাবনাটা জাগিয়ে তুলেছি মাত্র।’ 
‘সিরিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে, বিজয়ের স্থায়িত্ব নিয়ে তোমার উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। উৎকণ্ঠা মাঝারি মাত্রায় থাকলে নানা সিদ্ধান্ত আর উদ্যোগ নেওয়া যায়। আর টেনশন যদি না-ই থাকে বা সীমা লঙ্ঘন করে ঊর্ধ্বাকাশে উঠে যায়, তাতেও কোনো উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা যায় না।’
‘আমার উৎকণ্ঠা কি সীমা লঙ্ঘন করেছে?’
‘না। সীমার মধ্যে আছে! এজন্য সিরিয়ার পাশাপাশি তোমার মনে মিয়ানমারের মংডু শহর নিয়েও ভাবনা আছে!’
‘ঠিক বলেছ। দীর্ঘ এগারো মাসের লড়াইয়ের পর রোহিঙ্গা অধ্যুষিত মংডু টাউনশিপের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। ফলে বাংলাদেশ-মিয়ানমার ২৭০ কিলোমিটার সীমান্তের পুরোটাই আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে! কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশ অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছে। এদের মধ্যে আছে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু। তারা উচ্ছেদ আতঙ্কে দিন পার করছে।’
‘সেই আতঙ্ক তোমার মধ্যেও চাপ তৈরি করছে! মানবিক কারণেই এমনটা ঘটছে। শুধু দেশ আর দেশের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবছ না।’
‘টেকনাফ বর্ডার দিয়ে বৈধভাবে যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য চলমান ছিল তাও বন্ধ আছে। দেশের অর্থনীতিতে চাপ পড়বে না?’
পুষ্পর প্রশ্ন শুনে খুশি হয়ে গেলেন রবিকবি। এমন দেশ-সচেতন তারুণ্যের সম্মিলিত শক্তি নিশ্চয়ই দেশ গঠনে ভালো ভূমিকা রাখবে। ভেবে প্রশ্ন করলেন, ‘এত অল্প বয়সে এত মানবিক হলে কীভাবে?’
‘কীভাবে? জানি না। আবার জানিও। আন্দোলনের সময় খুব কাছ থেকে দেখেছি সহযোদ্ধা ফারহানকে। নিজের দিকে তার খেয়াল নেই। খেয়াল অন্যদের দিকে। কারও কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, কারও কিছু লাগবে কি না– এসব নিয়ে স্লোগানমুখর বেপরোয়া সময়েও তাকে দেখেছি তৎপর হতে। এক সহযোদ্ধা সকালে নাশতা না-খেয়েই ছুটে আসে মিছিলে, একসময় মাথা চক্কর দিয়ে সে পড়ে যায়। ছুটে গিয়ে ফারহান তাকে সেবাশুশ্রূষা করা শুরু করে। যখন শুনতে পায় সে খেয়ে আসেনি, খাবার জোগাড়ের জন্য ছোটাছুটি করতে থাকে। কোথাও কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। দোকানপাটে শাটার লাগানো। হঠাৎ সবার কাছে ছুটতে লাগল সে। কারও ব্যাগে কোনো কিছু আছে কি না খোঁজ নিচ্ছে। ছুটে এলো আমার কাছেও? আমি সব সময় ব্যাগে রাখতাম ছোট ছোট বিস্কুটের প্যাকেট। ছেলেটাকে খাওয়ানো হলো, পানিও। সুস্থ হওয়ার পর তাকে বাসায় ফিরে যেতে বলল। ছেলেটা গেল না।’
হঠাৎ মোবাইল ফোনে নোটিফিকেশন আসায় অন করে দেখল যমুনা টিভির একটা নিউজ ক্লিপ– ‘ছাত্রলীগ আবার ভয়ংকর রূপে ফিরবে।’ 
নিউজটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে তুমুকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘দেখেছিস!’ 
‘দেখেছি।’
‘ভয় পাচ্ছিস!’
‘এ কারণে না কেবল। এতক্ষণ খেয়াল করছিলাম বিড়বিড় করে কার সঙ্গে যেন কথা বলছিলি! মনে হলো আলগা কিছু ভর করেছে তোর ওপর।’
টিভি স্ক্রলের ভয় উড়িয়ে দিয়ে পুষ্প বলল, ‘কয়েকজন বাসা বেঁধেছে আমার মস্তিষ্কে, লক্ষ লক্ষ স্নায়ুকোষ নিউরনের ভেতর। তাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে কথা বলি। তারা আমার কথা শোনে, আমাকে বোঝে। আমাকে পরামর্শ দেয়। আমি ধমকও দেই।’
‘ওরে বাবা, ধমকও দিস!’
‘হুঁ। দেই। তোকে দেই না? ওদেরও দিই। ওরা তো এখন আমার বন্ধু-সহচর। তুই যেমন। তবে পার্থক্য হলো তুই দৃশ্যমান, আর ওরা অদৃশ্য হয়েও দৃশ্যের চেয়ে বড় দৃশ্য হয়ে ব্রেইনে জেগে থাকে।’ মনে মনে বলল, ‘ঠিক বলেছি?’
প্রথমে উত্তর দিল ফারহান। বলল, ‘ঠিক।’
দ্বিতীয় উত্তরদাতা রবিকবি, বললেন, ‘মধুর ঠিক।’
তৃতীয় উত্তর দিলেন বিদ্রোহী সম্রাট। বললেন, ‘ঝঞ্ঝার মতো ঠিক।’
চতুর্থ উত্তর দিলেন ‘কিশোর’ কবিতায় নবীনদের ‘অগ্রদূত’ উপাধি দেওয়া কবি। বললেন, ‘মহান কথা।’
পঞ্চম উত্তর দিলেন রূপসী বাংলার কবি, ‘প্রকৃতির মতো নির্মল কথা, কুয়াশার মতো ঝরেছে।’
ফারহান ও রবিকবির মতো তাদের প্রত্যেকেই কাব্যপ্রেমী পুষ্পর মস্তিষ্কে আসন পেতে বসে আছেন। তার মনোজগৎ ও কাব্যসত্তা দখল করে আছেন।
অটো চলতে শুরু করেছে। মিরপুর সড়ক বেশি লাল দেখাচ্ছে গুগলম্যাপে। তুমু বলল, ‘শাহবাগ হয়ে এগোলে ভালো হয়।’
কথা শুনেই অটোচালক বাঁয়ে ঘুরিয়ে দিল। এলিফ্যান্ট রোড বরাবর এগিয়ে যেতে লাগল। আশ্চর্য পুরো সড়ক প্রায় শূন্য। 
‘সড়ক শূন্য মানে সামনে বিপদ, ঝামেলা।’ বলেছিল ফারহান। চট করে মনে পড়ে গেল তার কথা। চুপ হয়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে শুনল, ‘সব সময় আমার কথা মগজে ট্যাগ করে রাখলে চলবে?’
অলরাউন্ডার হলেও ফারহান ছিল প্রচারবিমুখ। নিজের কাজেই মগ্ন থাকত। কারও নামে দুর্নাম রটানো তো দূরের কথা, কেউ তাকে নিয়ে ঈর্ষা-হিংসা করলেও ক্ষতি করতে চাইলেও তার উপকারই করত সে। বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে স্পট ডেথ হয় তার।’ 
সহযাত্রীদের দলে নিজেও ছিল। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে গেলে দেশজুড়ে আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে। তার ছোট বোন ফারিন কাঁদে। তার মা কাঁদে। তার বাবা কাঁদে। সেও কেঁদে কেঁদে শক্ত হয়ে এখন ফারহানকে মস্তিষ্কে স্থান দিয়ে রেখেছে। তার ওপর কি অভিমান করা চলে?
ভাবনার আড়াল থেকে অভিমানের শক্ত চাকটা গলে গেল। আর জোরালোভাবে বলল, ‘অবশ্যই ট্যাগ করে রাখব, এটা আমার ফ্রিডম। সেখানে কি তুমি বাদ সাধবে?’
‘না। বাদ সাধব কেন? গণঅভ্যুত্থানে নিহত সকল শহীদের কথা যেন তোমার মাথায় থাকে, চাইব।’
‘সবার কথা মনে থাকবে, আছেও। সবার জন্য আমরা লড়ব আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। প্রকৃত কিলারদের বিচারে আমরা অবহেলা করব না। আসল খুনিদের নিশ্চয়ই সর্বোচ্চ সাজা হবে।’
ফারহানের মাথায় ঢোকানো ছিল পবিত্র কোরআন, কোরআনে হাফেজ সে। পুরোটাই তার মুখস্থ ছিল। তার চোখ-মুখ থেকেও ছড়িয়ে পড়ত আলো। আচমকা সে শুনল, ‘ফাবি আইয়ি আলা রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান।’ অর্থ ‘অতএব, তোমরা উভয়ে তথা জিন ও ইনসান তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে?’ (সুরা আর রাহমান: ৫৫.১৩)
চমকে গেল পুষ্প। মনোযোগ দিয়ে শুনল পুরোটা তেলাওয়াত।
আপা, ‘ডানে যাওয়া যাবে না।’
‘কেন?’ 
‘সব গাড়ি ফিরে আসছে। রিকশাও।’
অটো থেকে নেমে দাঁড়াল পুষ্প। পাশে দাঁড়ানো এক ট্রাফিক সার্জেন্টকে প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে, ভাইজান?’
উত্তর না-দিয়ে সরে যাচ্ছিল সার্জেন্ট। আচমকা তার চোখ গেল পুষ্পের ওপর। চট করে মুখোমুখি এসে বলল, ‘আপা, আপনি যেতে পারবেন। আপনাকে আমি চিনতে পেরেছি, আপনি গণঅভ্যুত্থানের ভাইরাল মুখ!’
‘কী হয়েছে? যা সবার জন্য নিষিদ্ধ তা আমার জন্য প্রযোজ্য কেন হবে? কী হয়েছে বলুন।’
‘ভার্সিটি ক্যাম্পাসে বন্ধের দুই দিন যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ক্যাম্পাসের সাতটি প্রবেশপথে তল্লাশিচৌকি বসানো হয়েছে। ক্যাম্পাসের পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে এই সিদ্ধান্ত এসেছে।’
অটোর কাছে এসে পুষ্প বলল, ‘তুমু নেমে আয়। হেঁটে যাব।’
সার্জেন্ট এগিয়ে এসে বলল, ‘আপা, আপনার অটো ছেড়ে দেব। নামবেন না। উঠুন।’
‘না।’ শক্তভাবে জবাব দিল পুষ্প। ‘আন্দোলনের সমন্বয়ক হিসেবে বাড়তি কোনো সুবিধা নিতে চাই না। দেশের আঠারো কোটি মানুষের মতো আমিও মানুষ। সবার অধিকার সমান। আমারও।’ v

© Samakal
Shares:
Leave a Reply