
বুড়ো বাক্সের ঘ্রাণে
কালের খেয়া
কিযী তাহ্নিন 2024-12-26
জরিনা গলি থেকে বের হয়ে সটান বাঁয়ে হাঁটা শুরু করল, জোরসে। ডানের পথটা ঠিক পথ। কী বুঝে বাঁয়ে গেল, কে জানে! আমি বেশ এঁকেবেঁকে আশপাশ কাটিয়ে ওর পিছু নিলাম। জরিনা গলা উঁচিয়ে অযথা আকাশ দেখবার ফাঁকে চোখের কোণ দিয়ে চিকন করে আমার উপস্থিতি মেপে নিল। কিছু বলল না। আমিও তো কিছু বলিনি যখন দেখলাম সে এই ভুল পথ ধরে এগোচ্ছে। এই যে উপেক্ষা করবার পারস্পরিক বোঝাবুঝি মাত্র তৈরি হলো, তা আমাকে বেশ আরাম দিচ্ছে। এই চিনিহীন শীতের দুপুরে হঠাৎ আজকের এই রোদ যেমন। কী আরাম, কী আরাম।
আমি জরিনার পিছু নিয়েছি ওর হাতের ওই জিনিসটার আকর্ষণে। একটা ট্যাপ খাওয়া টিনের বাক্স, দু’হাতে আঁকড়ে বুকে চেপে নিয়ে চলছে। নইলে ওই মেছতা পড়া মুখে আর কী দেখার আছে! বাক্সটার নিজস্ব ওজন বেশি, ভেতরে ঠনঠন করছে। তেমন জাতের কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। সেই বাক্স সামলাতে যেয়ে পাটকাঠি শরীরে যে কসরত করছে জরিনা, দেখবার মতন ঘটনা। আস্ত সার্কাস একদম মেয়েটা। বাক্সটার আকার গুঁতো খেয়ে খেয়ে নষ্ট হয়েছে, সামলানো মুশকিলও বটে। জরিনা হাত থেকে নামিয়ে বাক্সটা পায়ের কাছে রাখল, আর বাক্সের কোনায় পা লেগে রাস্তায় মুখ উল্টে পড়ল। আমি কাঁঠাল গাছের ডাল ধরে ঝুলতে ঝুলতে খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসলাম কিছুক্ষণ। উল্টো থেকে সোজা হয়ে উঠে বসতে বসতে অবাক হয়ে তাকায় জরিনা আমার দিকে। আমার আচরণ নির্মম বটে, কিন্তু কী করি? কেউ আছাড় খেয়ে পড়লে এমন হাসি পায় আমার।
হাসি থামিয়ে বলি, “কী ব্যথা পাইলা নাকি?”
যদিও তার চেহারার দিকে তাকালে কপালে লেপটে থাকা ধুলোবালি ছাড়া কোনো ব্যথার দাগ চোখে পড়ছে না। আমার প্রশ্নে এক চিলতে হাসি দিল যখন, বুঝলাম হাসলে জরিনার চেহারা পালটে যায়। বাতাসে দুলতে থাকা কুমড়ো ফুলের মতন আনন্দভাব জাগে। চোখের নিচের আর গালের দু’পাশের খয়েরি মেছতাগুলো পর্যন্ত হাসিতে আড়াল হয়ে যায়। জরিনার নাম আমাকে কেউ জানায়নি, আমি জেনে গিয়েছি। এলাকার সবাই জানে কমবেশি। মুদির দোকানটার ধারের পাঁচিলে বসে যখন পাড়ার মেয়েদের সাথে গুলতানি করে, কিংবা এলাকার রাস্তা প্রতিদিন সকালে ঝাড় দেওয়ার সময় পেছন থেকে কেউ তার নাম ধরে ডাকে, “এই জরিনা এই” সে ঝট করে ঘুরে তাকায়। তার উত্তরে সে কখনও বলেন, “কী?” সে তাকিয়ে থাকে যে তার নাম ধরে ডাকে তার দিকে। যতক্ষণ অপরজন আবার কিছু না বলছে, জরিনা পিটপিট চোখে তাকিয়ে থাকে। একবার নয়, বেশ কয়েকবার এমনটা কাছ থেকে দেখেছি। তার এই অদ্ভুত অভ্যাসের কারণে তার নামটা আর মেছতাওয়ালা মুখ আমার বেশ মনে আছে। নইলে এমন কতই তো এলাকায় আছে।
বেকায়দার শরীর থোবড়ানো টিনের বাক্সটা তুলে জরিনা আবার হাঁটা শুরু করে, আমিও। তার পেছন পেছন, কখনও আশপাশের আগাছা ঘাস দুমড়ে মুচড়ে, শিস বাজাতে বাজাতে, গা চুলকোতে চুলকোতে, দু’তিন দলা থুতু ফেলতে ফেলতে চলছি। বাক্সটা কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করছি। আমার উশখুশ উৎসাহ জরিনার চোখ এড়ায় না, তাকে ভাবায়ও না। সে হাঁপিয়ে ওঠে, কুৎসিত দর্শন বাক্সটা মাটিতে নামিয়ে ধুপ করে রাস্তায় বসে পড়ে। আমি তার চলার গতির সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটছিলাম। আচমকা তার এই ব্রেক কষাকষি সামলাতে না পেরে হালকা হোঁচট খেয়ে সামলে ওই যে পাঁচিলটা তার ওপর পা ঝুলিয়ে বসে পড়ি।
“আচ্ছা এ রাস্তায় লোকজন নাই ক্যান?”
আমি বাঁকা হাসি হাসি, “ভুল রাস্তা তো।”
“এম্মা সামনে বাবুর হাটের মোড় না!”
আমি এবার দাঁত কেলিয়ে হাসি, “সে তো উল্টো দিকে, ডান দিকের রাস্তায় গেলে পরে শেষ মাথায়।”
“আমারে তো দেখি পাগল ধরছে, আমি এই উল্টা রাস্তায় আসলাম ক্যামনে!”
“ক্যামনে?”
“আরে ধুর এই বাক্স নিয়ে এমন বেখেয়াল ছিলাম যে …”
“কী আছে বাক্সের ভিতরে?”
“বলব না।”
“ক্যান!”
“তোমার কী, তুমি কে?”
“আয় হায় আমারে চেনো না?” আমি অবাক হওয়ার ভান করে বলি।
জরিনা খেপে ওঠে। মুখে বলে না যে খেপেছে, কিন্তু ওই ফুলে ফুলে ওঠা নাকের ফুটো দেখলে বোঝা যায়, মুখটা কেমন কালচে ধূসর লাগে। হাসলে চেহারার ধরন একরকম, খেপে গেলে সব পালটে যায়, ভুরুর ছাঁচ দুটোও। ভারি মজার চেহারা। বাক্স নিয়ে আবার ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে উঠে হাঁটা দেয়। ভুল পথ ধরেই। আমি নিশ্চিন্তে বসে কারবার দেখি। সামনে গেলে একটা মৃত গলি, রাস্তা বন্ধ। ফিরে আসতে হবে। সঠিক রাস্তার দিকে যেতে চাইলেও ঘুরে আমার সামনে দিয়েই যেতে হবে। জরিনা ঘুরে না, শেষ মাথার কিছুটা আগেই দাঁড়িয়ে যায়। টিনের বাক্সটা নামিয়ে রেখে তার ওপরেই বসে পড়ে। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। কাঁদছে নাকি কে জানে? এগিয়ে যাই। নাহ কাঁদছে না, কিন্তু চেহারাতে মেছতার দাগগুলো কেমন দাঁত মুখ খিঁচিয়ে আছে। রাগে যন্ত্রণায় কাঁপছে।
বলি, “কী হলো আবার?”
“ধুর এই বাক্স খুলতে পারছি না আর।”
“আছে কী এই বাক্সতে?” উৎসুক আমার হাতের আঙুলগুলো নাচিয়ে প্রশ্ন করি।
“তোমার কী, এত জানতে চাও ক্যান?”
“বাহ, এত তেজ দেখাও ক্যান? যাই গা। আমি চাইলে কিন্তু বাক্স খুলতে হেল্প করতে পারতাম। তা তোমার যা দেমাগ!”
বাক্সের ওপর থেকে নেমে জরিনা মাটিতে বসে। আমি চলে যাব না দাঁড়িয়ে থাকব! ভাবছি।
ঠিক তখন জরিনা বলে, “বাক্সটা কিন্তু খুলে ফেলছিলাম তখন। যখন আমাকে তিনতলা ওই বাড়ি থেকে দিল। ওই যে নতুন বাচ্চা হলো যে বাড়িতে, ওরা বাড়ি বদল করবে। আমাকে বাক্সটা দিয়ে বলল, নে বাক্সে যা আছে সব তোর।”
“তো? সমস্যা কী?”
“এখন তো আর বাক্স খুলতে পারছি না।”
“কী ছিল বাক্সে, সোনাদানা?”
উদাস হয়ে যায় জরিনা। পিটপিট করে চোখের পাতা, অবাক তাকিয়ে থাকে। ওই যেমন করে ওর নাম ডাকলে পেছন ফিরে তাকে অমন। আমি আর ফিরে যাই না, যেতে পারি না। উবু হয়ে মুখোমুখি বসি। শখ করে একটা সোয়েটার পরে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম, বেশ জম্পেশ শীত পড়বে ভেবেছিলাম। টকটকে কমলা রঙের সোয়েটার। এখন শরীর কুটকুট করছে ঘামে। খুলে কোমরে বেঁধে ফেলি। দাঁতের কোনে দুপুরের সুপুরিটা জমে আছে জিভ দিয়ে টেনে এনে থুতু দিয়ে ফেলি। জরিনা তাকিয়ে দেখছে।
“কী সোয়েটারটা সুন্দর না, ঢাকা কলেজের উল্টোদিক থেকে কিনছি। প্রচুর দামাদামি করছি, হেব্বি জিতছি। বল তো দাম কত রাখছে?”
“খুশবু ছিল?”
“কী?”
“আরে বাক্সে একটা খুশবুর শিশি ছিল।”
“ওহ, শুধু একটা খুশবুর শিশি? দেশি না বিদেশি?”
“তা কি আমি জানি! আমার স্বামীর এমন খুশবুর শিশি ছিল।”
“তোমার স্বামী কই?”
“আছে হয়তো কোথাও।”
“তা তোমার বাক্সের সেই খুশবু কই?”
“সেই খুশবুর দোষেই তো ছুটছি। আমার স্বামীই আসলে ঠিক বলত একদম বুঝলা। বিয়ের পর লুকিয়ে তার খুশবু মাখতাম। একদিন ধরা পড়ার পর এমন মাইর দিল। বলছিল, ভালো মেয়েদের শরীরে আলগা খুশবু লাগে না।”
“তো?”
“আজকে মাথায় কি বদমাইশি চাপল। বাক্সে খুশবুর শিশি পেয়ে লোভ হইল এমন। আর বগল ঘেমে এমন বাজে অবস্থা। বাসার সাবানটাও ফুরিয়ে গেছে। বেতন পেলে কিনব। ইচ্ছে মতন কানের লতিতে, এই যে হাতে নাকের মধ্যে, গলায় ঘষলাম ওই কড়া খুশবু। তারপর পাড়ার লোকজন সেই গন্ধে এমন তাড়া করল, বেশ্যা খানকি বলে গালিও দিল ওই লোকটা, ওই যে পান বিড়ির দোকানদারটা। তা আমি কিছু মনে করিনি খারাপ কাজ করছি একটা, রাগ তো করবেই। স্বামীর কথা মনে হইল। ওই পাড়ার কালু কুত্তাটা, খুশবুর কড়া গন্ধে ত্যক্ত হয়ে তাড়া করল, ভয়ে শিশি ওই দোকানদারের দিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে দৌড় দিলাম। পথ ভুল তো এইসব গোলমালের জন্য হলো।”
“তোমার গা দিয়ে তো বিচ্ছিরি কাদামাটির গন্ধ আসতেছে। খুশবু কই?”
“কী টাটকা সুবাস ছিল, জানো? ওই মাটিতে আছাড় খেলাম, কাদায় পড়ে … ভাগ্যিস। এই কাদামাটির গন্ধই ভালো। শরীরে আর ওই নষ্ট মেয়েদের খুশবু নাই।”
বাক্সটাতে চিবুক রেখে রাস্তায় আধাশোয়া হয়ে আছে জরিনা।
আমি বলি, “আর কিছু ছিল না ওই বাক্সে?”
“চিরুনি ছিল।”
“কই?”
“ছুড়ে মেরেছি।”
“কোথায়?”
“ওই যে কালু কুকুরটাকে যখন দোকানদার আমার পিছে লেলায় দিল, আমাকে কামড় দিবে বলে ও তেড়ে আসলো, সাথে চিকন গলার খাইষ্টা লোকটা, ওই যে কলপাড়ে বসে খিস্তি করে যে, কী সব বলতেছিল! চিরুনিটা আমার হাতে ছিল, ওর চোখের দিকে ছুড়ে মেরেছি। তারপর দৌড়।”
এবার আবার পাটপাট করে উঠে বসল জরিনা। “হিসাব করে দেখ ওই খুশবু আর চিরুনি বাজারে বিক্রি করলে একশ টাকা তো নগদে পাইতাম, তাই না? ষাইট-সত্তর টাকা তো পাইতামই। সাবানটা আজকেই কিনতে পারতাম তাইলে। গায়ে কী গন্ধ!”
ভারী হতাশ লাগে। এই প্লাস্টিকের পুরোনো চিরুনি আর সস্তা খুশবুর জন্য ঘুরে ঘুরে মরছে এই মেয়ে। ধুর। আর আমিও-বা কী ভেবে আমার এত সময় নষ্ট করলাম। দামি কিছু থাকলে পটিয়ে বাজারে বিক্রি করে কমিশন বাগানো যেত। ছেমড়ির গালে কষে থাবড়া দিতে মন চাচ্ছে।
ক্যাটক্যাট করে বলি, “তা এখন এই বেকায়দার বাক্স নিয়ে লুটোপুটি খাচ্ছ ক্যান রাস্তায়? ঘরে যাও।”
“আরও একটা জিনিস আছে তো, কায়দা করতে পারছি না।”
“উফফ কী সেটা?”
“নাম জানি না। কী কাজ তাও জানি না।”
“দাও দেখি আমি দেখে বুঝি।”
“বাক্সের মুখ তো বেকায়দায় আটকে গেছে গো। ক্যামনে দেখবা?”
“সরো সরো দেখি, এমন বাক্স খোলা ওয়ান টু কা খেল হ্যায়। দাও দেখি।”
বহু ধস্তাধস্তি করি, মুখটা কেমন বেঁকে আটকে আছে, বাক্সের ছিটকিনি পুরা তব্দা খেয়েছে। কোনোভাবেই খোলা যাচ্ছে না।
“কেমন দেখতে ছিল সেটা বল?” গুঁতোগুঁতি করতে করতে জিজ্ঞেস করি।
“ইয়া বড়।”
“তা নরম না শক্ত?”
“শক্ত শক্ত পাথরের মতন ভারী।”
“রং কী?”
“সে অনেক রং আমি এত কিছু চিনি না, হলুদ খয়েরি নীল।”
“বাপরে সে আবার কী জিনিস। চার কোনা নাকি গোল?”
“এইগুলা বুঝি না। গোল না মনে হয়। চার কোনাও না।”
ধুর। এই জিনিস দিয়ে কী লাভ? আমার যে কয় ঘণ্টা নষ্ট হলো, এখন যদি বাক্সে কিছু না পাই, কয়টা পয়সা ইনকাম করব ক্যামনে?
বলি, “জরিনা বাক্সটা আছাড় দিয়ে ভাঙি?”
“আরে না না, এইটাতে আমি আমার কাপড় রাখব, বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হয়।”
“কয়টা কাপড় তোমার?”
“তিনটা শাড়ি, দুইটা হইল প্রতিদিনের জন্য, আর একটা ঈদের দিনে পরি। আগে তো দুইটা ছিল, এখন তিনটা।” গালজুড়ে হাসে, চোখ ছোট হয়ে হাসিতে চিকমিক করে।
আর আমার চোখ ওর ধুলোমাখা ফিনফিনে ব্লাউজের আড়াল দিয়ে ফুটে ওঠা কচি ডাবের মতন বুক চোখ পড়ে। এই কিছুদিন আগে জেগেছে এই শরীর, নতুন চরের মতন, তাকিয়ে বেশ বুঝতে পারি। চটক আছে এখনও। জিভখানা আমার অজান্তেই ঝুলে পড়ে। আর অমন বুক দেখতে দেখতে, আর বাক্স টানতে টানতে খ্যাচাং করে বাক্সের মুখ খুলে ডালা হাঁ হয়ে যায়। বুড়ো বাক্সের পেটের ভেতর থেকে সেই জিনিস তুলে আনি।
“এ কী! এই তোমার সে জিনিস?”
“হুম।”
“ধুর। তুমি এইটা চেনো না!”
“কী এইটা, নাম জানি না।”
বাক্সের মধ্য থেকে আমি একটা হলুদ সবুজ রঙের চাবিওয়ালা গাড়ি বের করি, যার ওপর বসে আছে লাল রঙের ঘোড়া। এই একটা পেঁপের সমান জিনিস, এ নাকি বিশাল!
“খেলনা।”
“ওহ।”
“তুমি খেলনা চেনো না শালি? ঢং মারাও?” এমন মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আমার।
হাত-পা ছড়িয়ে জরিনা খেলনা আঙুলে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে।
“এই দেখো চাবি, ছাড়ো ছাড়ো, দেখো ঘোড়ার গাড়ির মতন চলবে।”
ছিটকে ওঠে জরিনা। “ও আল্লাহ এইটা দেখি নড়ে।”
“তুমি খেলোনি কখনও?”
জরিনা গাড়ির পেছন ছুটতে ছুটতে দৌড়ায়। আঁচল ফেলে পেটের শাড়ি খসিয়ে আলুথালু। চাবিওয়ালা গাড়ি থেমে গেলে শাড়ি সামলে আবার ফিরে আসে।
আমি সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলি, “ছোটবেলায় এগুলা তো সব্বাই খেলছে। মেলায় পাওয়া যেত তো।”
“ও।”
“তুমি ছোটবেলায় কী খেলছো?”
“কবে!”
“যখন ছোট ছিলা?”
“ওহ তখন, তখন তো আমার বোন ছিল ছোট।”
“তারপর?”
“আমার জন্মের পরের বছর আমার ছোট বোন জন্মাইল, আর মা মরল।”
“বাপ?”
“বাপ কি একা সামলাতে পারে? ছোট বোনকে দিয়ে দিল আমার খালার বাড়ি।”
“আর তুমি?”
“আমার ঠিক মনে নাই। আমার দুইটা জামা ছিল এইটা মনে আছে। একটা গোলাপি আর সাদার মধ্যে হলুদ বুটি। যখন শরীরে আর জামা আঁটে না তখন আম্মার শাড়ি ছিল দুইটা, সেইটা পরতাম। তার কয়দিন পর তো বিয়ে হয়ে গেল, না? আমি ভাত সালুন রান্না করতে পারতাম, কলপাড় থেকে পানি টেনে আনতে পারতাম। সব পারি, তাই বিয়া দিয়া দিল আব্বা। শুধু লম্বায় অনেক খাটো ছিলাম তখন, এইটুকুন। নাগাল পাইতাম না কিছুর। চেয়ারের ওপর খাড়ায় ওই খুশবুর শিশি টানতাম। একবার তো শিশি আরেকটু হলে ভাঙে, তখন স্বামী মারছিল। বললাম না? তার অনেক শখের সুগন্ধি ছিল তো।
“তোমার পোলাপান নাই?”
“একটা পেটেই মরছে। আর তো হয়নি।”
“বেচবা নাকি এইটা বাজারে? দুইশ টাকা পাওয়া যাবে। একশ তোমার, একশ আমার। আজকেই সাবান কিনতে পারবা তাইলে।”
“খেলনাটা?”
“হুম।”
“একটু দেখি, আরেকটু। কী মজা, ওপরের এই কুত্তাটা আবার ঘাড় ঘুরায় নাচে।”
“এইটা কুত্তা না ঘোড়া।”
“ওহ।”
আমি হাঁটি, ঠিক পথের দিকে এগুচ্ছি। পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে জরিনা দৌড়াচ্ছে। কখনও চাবিওয়ালা পাগলা ঘোড়ার পেছনে, কখনও নিজেই ঘোড়ার মতন করে ছুটছে। তার আলুথালু আঁচল উল্টেপাল্টে দিশেহারা। তার আঁচল কেমন ডানা ঝাপটাচ্ছে কিংবা আমার চোখে বিভ্রম। পৌষে এমন ঘন সোনা রোদ! তার মাঝে একমুঠো হাওয়ার মতন উড়ছে জরিনা আর ওই চাবিওয়ালা লাল ঘোড়া। যৌবনের কাঁচা ঘ্রাণ মাখা শরীরে ঘুড়ির মতন শৈশব জড়িয়ে যাচ্ছে।
এই যে এতক্ষণ ছিলাম, জরিনা আমাকে একবারও জিজ্ঞেস করেনি আমার পরিচয়।
যদি করত আমি ঠিক বলে দিতাম, “আমি এক ছ্যাঁচড়া চোর।”
পথ হাঁটি। কোমর থেকে কমলা সোয়েটারের গিঁট খুলতে খুলতে শিস বাজাই, মাথায় ওই পুরোনো গানটা ক্যান যেন ঘুরছে, “লালালা লা লা স্বজন ও আমার স্বজন … মেরে দিল ভি কিতনা পাগল হ্যায়” বেলা যে যায় যায়। আজকের দিনটা পুরাই লস। অন্য কোথাও চুরির ধান্দা করতে হবে।
আমি এক চোর বটে। কিন্তু যে নারীর শৈশব চুরি গেছে, তার খেলনা চুরি করবার মতন বেহায়া আমি নই।
***
নবনীতা দেব সেনের ‘মেয়েটা’কে ভালোবেসে।