
সড়ক বন্ধের সংস্কৃতি বন্ধ হোক
মতামত
অনি আতিকুর রহমান 2025-01-12
রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে মানুষের আবেগ-উচ্ছ্বাস থাকবে। এটি দোষের কিছু নয়। কিন্তু সেই আবেগ প্রদর্শন যদি অসংখ্য মানুষের ভোগান্তির কারণ হয়; তবে সেটি বিবেক দিয়ে ভাবা দরকার। জনস্বার্থবিরোধী যে কোনো আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সড়ক অবরোধ করে প্রটোকল দেওয়া রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।
একজন রাজনীতিবিদ কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বিভিন্ন প্রয়োজনে দেশ-বিদেশ সফর করতেই পারেন। কিন্তু সেটিকে কেন্দ্র করে যখন মানুষের ভোগান্তি বাড়ে, তখন তা অত্যন্ত হতাশার। যেমন ৭ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তাঁর এই যাত্রা দেশের রাজনীতিতে যেমন আলোচিত ছিল, তেমনি নেতাকর্মীর মধ্যেও খুব আনন্দের উপলক্ষ। ফলে তাঁকে বিদায় জানাতে এয়ারপোর্ট এলাকায় ছিল নেতাকর্মীর ভিড়। ওইদিন সন্ধ্যার পর থেকেই এয়ারপোর্টমুখী সড়কে যান চলাচলে স্থবিরতা দেখা দেয়। এক পর্যায়ে গাড়ির চাকা থেমে যায়। এতে প্রায় চার ঘণ্টার যানজটে পড়েন যাত্রীরা। এর প্রভাব পড়ে প্রায় পুরো ঢাকার সড়কপথে। দীর্ঘদিন পর চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে গেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তাঁর এবারের বিদেশযাত্রা নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভ্রমণের রাজনৈতিক-কূটনৈতিক গুরুত্ব আলোচনা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়।
এ অবস্থায় কর্মীদের উচিত নেতার সুস্থতা কামনায় দোয়া করা। এর চেয়ে বড় সমর্থন আর কী হতে পারে? কিন্তু দোয়ার পরিবর্তে তারা ঢাকার ব্যস্ততম সড়কগুলোতে অবস্থান নিয়েছে। এতে রাস্তা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে পথচারীদের ভয়াবহ ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে।
দেশে এ ধরনের ঘটনা নতুন কিছু নয়। কিন্তু আমরা কেন এ ধরনের আচরণ যুগের পর যুগ ধরে রাখব? এমনিতেই ঢাকার ট্রাফিকের চাপ অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। এ ধরনের যানজটে বহু মুমূর্ষু রোগী অ্যাম্বুলেন্সে আটকে থাকেন। কতজনের জরুরি মিটিং মিস হয়। আমি নিজেও এ রকম পরিস্থিতিতে একটা অনুষ্ঠানে যেতে পারিনি; মাঝপথ থেকে ফিরে এসেছি। ৩০ মিনিটের রাস্তায় ৩ ঘণ্টা আটকে ছিলাম।
আমরা যারা ঢাকায় বসবাস করি, তাদের প্রতিনিয়ত এই বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। ‘ভিআইপি পাস’-এর নামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কে কাটাতে হয়। নাগরিকদের ভোগান্তি দেওয়ার এই সংস্কৃতি কি পৃথিবীর কোনো দেশে আছে?
লাখ লাখ মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে প্রটোকল দেওয়ার রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির পরিবর্তন হতে হবে। আমাদেরও এই অপসংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে। সব রাজনৈতিক সংগঠনকে এমন কার্যকলাপ পরিহার করা অত্যন্ত আবশ্যক।
একটা ঘটনা বলে শেষ করব। ছাত্রজীবনে যখন আমরা হলে থাকতাম, তখন মনে মনে শেখ হাসিনার পতন চাইতাম। কেন জানেন? বড় কোনো কারণে নয়। উচ্চ শব্দে যাতে মাইক বাজানো বন্ধ হয়। দলের কিছু কর্মী ক্যাম্পাসে পুরো মাস মাইক বাজাত। ৭ মার্চের ভাষণ আমরা প্রত্যেকেই পছন্দ করি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, বিরতিহীনভাবে উচ্চ স্বরে আপনি তা শুনতে বাধ্য করবেন। আমাদের ক্যাম্পাস ছিল ১৭৫ একরের ছোট্ট গণ্ডি। সেখানে অন্তত ১০টি মাইক বাজানো হতো। সবই উচ্চ স্বরে। আবাসিক হলগুলোতে কে অসুস্থ কিংবা কার পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে, তা দেখার সময় যেন কারও নেই।
সবচেয়ে মুশকিলের কথা, এসব নিয়ে আপনি কিছু বলতেও পারবেন না। বললেই বিপদ। মামলার আসামিও হতে পারেন! এমন পরিস্থিতিতে একজন দুর্বল কল্পনাবিলাসীর পক্ষে মনে মনে মহাপ্রতাপশালীর পতন চাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। ‘অ্যান্টি কনসেন্ট’ কত ক্ষুদ্র ভুলের কারণে উৎপাদন হতে পারে– রাজনৈতিক দলগুলোকে সে কথা মনে করিয়ে দিলাম আর কি। আশা করি, তারা এ বিষয়কে গুরুত্ব দেবে।
অনি আতিকুর রহমান: সহসম্পাদক, সমকাল
atikbanglaiu@gmail.com