
অর্ধেক কাজও হয়নি ৭৫% বিল শোধ
সারাদেশ
আমিনুল ইসলাম খান রানা, সিরাজগঞ্জ 2025-01-10
সিরাজগঞ্জ থেকে বগুড়া সরাসরি যোগাযোগে পাঁচ বছর আগে সাড়ে ২১ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ ও সম্প্রসারণ প্রকল্প নেয় সরকার। দীর্ঘদিনেও ভূমি অধিগ্রহণ হয়নি। সাড়ে চার বছরে মাত্র ৩০ শতাংশ কাজ হয়েছে। কিন্তু দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জামিল ইকবাল ও মইনুদ্দিন বাঁশি কনস্ট্রাকশন প্রায় ৭৫ শতাংশ বিল তুলে নিয়েছে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) সিরাজগঞ্জের সাবেক-বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী এবং বিভাগীয় ও উপসহকারী প্রকৌশলীদের যোগসাজশে অধিকাংশ কাজ না করে বিল হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০২০ সালের জুলাইয়ে শুরু হয় ‘সিরাজগঞ্জ-বাগবাটি-গোসাইবাড়ী’ সড়ক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ। চলতি বছরের জুনে সাড়ে ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ১৮ ফুট প্রশস্ত সড়কটি করার কথা রয়েছে। দুটি প্যাকেজে ১১৭ কোটি টাকা ব্যয়ের গ্রামীণ সড়কের ১০ কিলোমিটারে কোনো কাজই হয়নি। বাকি অংশও হয়েছে দায়সারা। স্থানীয়দের অভিযোগ, সওজের প্রকৌশলীরা পতিত আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে মিলে হিন্দুসহ কয়েকশ পরিবারের জমি অধিগ্রহণ না করে ভয়ভীতি দেখিয়ে দখলের পর সড়ক করছেন।
রায়গঞ্জ উপজেলার ব্রহ্মগাছা ইউনিয়নের নির্মল ঘোষের অভিযোগ, বাবা-দাদার জায়গায় মাটি কেটে রাস্তা করা হচ্ছে। সরকারিভাবে আমাকে ক্ষতিপূরণ দূরে থাক, আশ্বাসও দেয়নি। ঠিকাদারের লোকজন গায়ের জোরে কাজ করছেন। প্রতিবাদ করলে মামলার ভয় দেখান। একই এলাকার সুনীল ঘোষ বলেন, ‘ভেকু দিয়ে বাজারে আমার চা দোকান গুঁড়িয়ে দিয়েছে। জমি অধিগ্রহণ না করে এত তাড়াহুড়োর মানে কী?’
জানা যায়, সিরাজগঞ্জ সদর, রায়গঞ্জ ও কাজীপুর এবং বগুড়ার ধুনটের ১০টি ইউনিয়নের ৩০ গ্রামের প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষের চলাচলের জন্য ১২ ফুট চওড়া গ্রামীণ সড়কটি করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। পরে সড়কটি ১৮ ফুটে সম্প্রসারণ কাজ করছে সিরাজগঞ্জ সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে এ জন্য দুটি প্যাকেজে ১১৭ কোটি টাকা ব্যয়ের মধ্যে ৯৪ একর জমি অধিগ্রহণে রাখা হয় ১০০ কোটি। কিন্তু সাড়ে চার বছরে জমি অধিগ্রহণ হয়নি। আংশিক কাজ করেই সিংহভাগ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সওজের প্রকৌশলীদের অনিয়ম ও লুটপাটের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক নবকুমার কর্মকার বলেন, পতিত আওয়ামী লীগ আমলে সওজের প্রকৌশলীরা অর্থ লোপাটে বহু ভুয়া প্রকল্প নিয়েছেন। তারা মানুষের সঙ্গে জবরদস্তি করেছেন। জমির মালিকদের ভয়ভীতি দেখানোর ঘটনায় নির্বাহী প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি।
এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রামীণ সড়কটি প্রথমে আমরা নির্মাণ করি। কিন্তু ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিশেষ কৌশলে নিয়ন্ত্রণ নেয় সওজ। আমাদের অধীনে প্রতি কিলোমিটার সম্প্রসারণে (গাইডওয়াল, সুরক্ষাসহ) এক থেকে দেড় কোটি টাকা লাগার কথা। এই হিসাবে সাড়ে ২১ কিলোমিটারের কাজ ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকায় শেষ হতে সর্বোচ্চ তিন বছর লাগত। সওজের কেন এত বেশি সময় লাগছে, তা তারাই ভালো জানেন।’
অভিযোগের বিষয়ে মেসার্স জামিল ইকবাল কনস্ট্রাকশনের প্রকল্প ব্যবস্থাপক বলেন, ‘আমাদের অংশে ভূমি অধিগ্রহণ হয়নি। শুরু থেকেই স্থানীয়দের বুঝিয়ে কাজ করছি। যতটুকু কাজ করেছি, তার চেয়ে ৭-৮ কোটি টাকা কম বিল নিয়েছি।’ আর মেসার্স মইনুদ্দিন বাঁশি কনস্ট্রাকশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি সলেমান হোসেন বলেন, ‘আমরা চারজন সাব-ঠিকাদার কাজ করছি। ভূমি মালিকদের সঙ্গে আমরা কোনো জবরদস্তি করিনি।’
সিরাজগঞ্জ সওজের বিভাগীয় প্রকৌশলী জাহিদুর রহমান মিলু বলেন, ‘দুটি প্যাকেজে প্রায় ১১৭ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র দুটি গ্রুপের ঠিকাদারকে ৪০ শতাংশ বিল পরিশোধ করা হয়েছে। দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই।’
সিরাজগঞ্জ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ইমরান ফারহান সুমেল বলেন, ‘জমি অধিগ্রহণে ১০০ কোটি টাকা চাওয়া হলেও মিলেছে মাত্র ২৫ কোটি। সেটি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় পাঠানো হয়েছে। জমির প্রকৃত মালিকরা অবশ্যই ক্ষতিপূরণ পাবেন।’ তিনি বলেন, ‘৫০ থেকে ৬০ শতাংশ কাজ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ৮৮ কোটি টাকা বিল দেওয়া হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা না হলে নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্প শেষ হতো।’
রাজশাহী অঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘জেলা প্রশাসন,
গণপূর্ত, বন বিভাগ ও সওজ শিগগির ভূমি অধিগ্রহণের কাজ করবে। ঠিকাদারের বিল
দেওয়ার আগে আমাদের বিভিন্ন তদারকি দল মাঠ পর্যায়ে যাচাই করে। ফলে অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ নেই। ক্ষতিপূরণ না পেলে অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রশাসনিক অনুমোদন থাকলে দ্রুত অধিগ্রহণ করতে পারে। সওজের হয়তো এ অনুমোদন নেই। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’