আপনার স্মার্টফোন দিনে ২৪ ঘণ্টা আপনার কথা শুনছে? আগ্রহ বুঝে কিভাবে ফাঁদে ফেলছে!
কল্পনা করুন, আপনি বন্ধুদের সাথে বসে এক জোড়া দারুণ স্পোর্টস শু নিয়ে কথা বলছেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফোনে ভেসে ওঠে সেই ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন। আপনি তো সার্চও করেননি! মুহূর্তেই মনে প্রশ্ন জাগে ফোন কি আমার কথা শুনেছে?
প্রশ্নটা আপনার একার নয়। বর্তমান ডিজিটাল যুগে এ প্রশ্ন যেন প্রতিটি সচেতন নাগরিকের মনে হানা দেয়। তবে বাস্তবতা, বিশ্বাস করুন, আরও বেশি চমকপ্রদ এবং একটু হলেও গা ছমছমে। আজ আমরা খুলে দেখবো সেই রহস্যের পর্দা। জানবো, কীভাবে আমাদের স্মার্টফোন চুপিসারে আমাদের বোঝে, আর কেমনভাবে আমাদের আচরণ দিয়েই ফাঁদ পেতে আমাদের আগ্রহকে ব্যবহার করে।
ফোন কি আসলেই আপনার কথা শুনছে?
সবার আগে আসা দরকার সবচেয়ে বড় প্রশ্নে ফোন কি আসলেই আমাদের কথা শুনছে?
গুগলের মতে, তাদের ডিভাইসগুলো শুধুমাত্র তখনই ভয়েস রেকর্ড করে যখন ব্যবহারকারী স্পষ্টভাবে বলে (Hey Google) অথবা নির্দিষ্ট ভয়েস কমান্ড দেয়। এর বাইরে নাকি কোনো কথা রেকর্ড করা হয় না।
তবে সমস্যা হলো, বাস্তবতা এতটা সরল নয়।
অনেক অ্যাপ্লিকেশন আপনার অনুমতি নিয়ে মাইক্রোফোন অ্যাক্সেস রাখে। এমনকি, কিছু অ্যাপ ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকা অবস্থায় শব্দের বিশেষ প্যাটার্ন শনাক্ত করতে সক্ষম। যেমন, আপনি যখন প্রাইস, ডিসকাউন্ট, শপিং ইত্যাদি শব্দ উচ্চারণ করেন, তখন কিছু নির্দিষ্ট কীওয়ার্ডের ভিত্তিতে আপনার কথার ইঙ্গিত ধরার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
এখন পর্যন্ত, অবশ্য সরাসরি প্রমাণ মেলেনি যে আপনার ফোন রিয়েল-টাইমে সবকিছু শুনে ফেলছে। তবুও, আচরণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে যে পরিমাণ সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাস ফোন দিতে পারে, তা অনেকের কাছেই ভয়ানক বাস্তব মনে হয়।
আপনার স্মার্টফোন কীভাবে আপনাকে বোঝে?
এখানেই আসে এক গোপন খেলা বিহেভিয়ারাল টার্গেটিং।
আপনি যখন ইন্টারনেটে ঘুরে বেড়ান, আপনার প্রতিটি কাজ রেকর্ড হয় আপনি কোন ওয়েবসাইটে যান, কোন পণ্যদ্রব্যের প্রতি একটু বেশিই সময় ব্যয় করেন, কোন ভিডিওতে ক্লিক করেন, কোথায় অবস্থান করছেন, কাকে মেসেজ করছেন সবকিছু।
এইসব ভিন্ন ভিন্ন তথ্য একত্র করে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো তৈরি করে আপনার ডিজিটাল প্রোফাইল।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, গড়ে মাত্র ৫০০টি অনলাইন ক্লিক বিশ্লেষণ করলেই একটি মানুষের ব্যক্তিত্ব, রুচি এবং ভবিষ্যৎ চাহিদা সম্পর্কে অবিশ্বাস্য নির্ভুলতায় ধারণা করা যায়।
ফলাফল?
আপনার হাতে মোবাইল ফোন থাকলেও আসলে আপনি নিজেই একটি চলমান ডেটা সেন্টার, যার প্রতিটি পদক্ষেপ প্রযুক্তি জগতের বিশ্লেষণের খাদ্য।
কাকতালীয় নয়, বরং পূর্বনির্ধারিত ফাঁদ
অনেক সময় মনে হয়, আরে, আমি তো নতুন কোনো অ্যাপে যাইনি, কোনো কিছু সার্চ করিনি, তাও কিভাবে এই বিজ্ঞাপন এলো?
এই অনুভূতির পেছনে থাকে অত্যন্ত সূক্ষ্ম একটি সিস্টেম অ্যালগরিদমিক প্রেডিকশন।
বিখ্যাত প্রযুক্তি বিশ্লেষক Tristan Harris, যিনি আগে গুগলের নৈতিক নকশা বিভাগের কর্মী ছিলেন, বলেন,
আপনি যদি বিনামূল্যে কোনো ডিজিটাল সার্ভিস ব্যবহার করেন, তাহলে আপনি সেই পণ্য।
আপনার অনলাইন ও অফলাইন অভ্যাসের ভেতরকার লুকানো তথ্যগুলো একত্র করে এআই (Artificial Intelligence) ভবিষ্যদ্বাণী করে:
- আপনি কোন সময় কোথায় থাকতে পারেন,
- কোন পণ্যের প্রতি দুর্বলতা দেখাতে পারেন,
- কিংবা কোন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করতে পারেন।
অর্থাৎ, আপনি কিছু খোঁজার আগেই আপনার হাতে চলে আসে সেই তথ্য ঠিক তখনই, যখন আপনার মনে সেই আগ্রহ উঁকি দিচ্ছে। মনে হয় যেন ফোন আপনাকে পড়ে ফেলেছে।
ব্যাকগ্রাউন্ড মাইক্রোফোন অ্যাক্সেস:
আপনি যখনই কোনো অ্যাপ ইন্সটল করেন, খুব সম্ভবত আপনি পড়েও দেখেন না কী কী পারমিশন চাইছে। বেশিরভাগ অ্যাপই চুপিসারে চেয়ে নেয় মাইক্রোফোনের অনুমতি।
প্রযুক্তি সাইট Wired একটি গবেষণায় দেখায়, জনপ্রিয় অনেক অ্যাপ (বিশেষ করে শপিং, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ফ্রি গেমস) নিজেদের টার্মসে মাইক্রোফোন ব্যবহারের কথা লেখে, কিন্তু বাস্তবে অনেক বেশি ডেটা সংগ্রহ করে নেয়।
যদিও এগুলো সবসময় রিয়েল টাইম শোনা হয় না, তবে শব্দের ধরন বা পরিবেশ বিশ্লেষণ করে আগ্রহের ইঙ্গিত টের পাওয়া যেতে পারে।
আপনি হয়তো জুতার কথা বললেন, ফোন সরাসরি সেটা শুনেনি, কিন্তু আপনি আগে কোথায় ঘুরেছেন, কী সার্চ করেছেন, কোন প্রোডাক্ট ব্রাউজ করেছেন এগুলো বিশ্লেষণ করে ফোন বিজ্ঞাপন প্রস্তুত রেখেছে। আপনার বলা (নতুন জুতা) কেবল আগ্রহের সূচক হিসেবে কাজ করেছে।
আপনি কিভাবে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন?
এই আগ্রাসী নজরদারির যুগে নিজেকে বাঁচাতে চাইলে অবশ্যই কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
প্রথমেই যা করবেন:
- গুগলের My Activity পেজে গিয়ে আপনার অনলাইন কার্যকলাপ রিভিউ করুন।
- অপ্রয়োজনীয় অ্যাপের মাইক্রোফোন অ্যাক্সেস বন্ধ করে দিন।
- আপনার Web and App Activity বন্ধ করুন।
- DuckDuckGo বা Brave এর মতো প্রাইভেসি-ফোকাসড ব্রাউজার ব্যবহার করুন, যেখানে ট্র্যাকিং কম হয়।
- এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, Google Account এর Data & Privacy ট্যাবে গিয়ে দেখুন কোন কোন ডেটা সংরক্ষিত হচ্ছে এবং সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করুন।
তথ্যপ্রযুক্তির যুগে নিজের তথ্য নিজেই নিরাপদ রাখতে হবে। নিয়মিত সচেতনতা ছাড়া নিরাপত্তা সম্ভব নয়।
স্মার্টফোনের গোয়েন্দাগিরি:
একসময়, মোবাইল ফোন ছিল শুধুমাত্র কথা বলার একটি মাধ্যম। ফিচার ফোন যুগে আপনি ফোনে যা করতেন, তা সীমাবদ্ধ ছিল কথা বলা, টেক্সট পাঠানো আর গেমস খেলা।
কিন্তু আজকের স্মার্টফোন হলো একটি সর্বক্ষণিক সংযোগস্থল, যা শুধু আপনার কথাবার্তা নয়, আপনার জীবনধারা, মানসিকতা এবং ভবিষ্যৎ ইচ্ছাগুলোকেও পর্যবেক্ষণ করে।
University of Oxford এর একটি গবেষণা বলছে, আধুনিক স্মার্টফোন প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৬০০০ ধরনের ডেটা পয়েন্ট সংগ্রহ করে।
এগুলোর ভেতর রয়েছে
- আপনি কতক্ষণ কোন অ্যাপে থাকলেন,
- কোন ছবিগুলো আপনি জুম করে দেখলেন,
- কতক্ষণ কোন পণ্যের উপর থেমে ছিলেন,
- এমনকি আপনি কিভাবে স্ক্রল করেন, উপর থেকে নিচে না নিচ থেকে উপরে!
এই বিশ্লেষণ আপনার সম্পর্কে এমনসব তথ্য তৈরি করে, যা হয়তো আপনিও নিজের সম্পর্কে এতটা গভীরভাবে জানেন না।
বিহেভিয়ারাল টার্গেটিংয়ের ভবিষ্যত:
বর্তমানে বিহেভিয়ারাল টার্গেটিং যেখানে আছে, ভবিষ্যতে তা হবে আরো বেশি ব্যক্তিগত, আরো বেশি নিখুঁত।
বিশ্ববিখ্যাত প্রযুক্তি পরামর্শক Gartner পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৫ – ২৬ সালের মধ্যে ৮০% অনলাইন বিজ্ঞাপন হবে Predictive Behavioral Targeting ভিত্তিক, যেখানে আপনার কথার ধরণ, আবেগের ওঠাপড়া, এমনকি চোখের মুভমেন্টও বিশ্লেষণ করা হবে।
কীভাবে?
- Emotion AI বা আবেগ বিশ্লেষণ প্রযুক্তি ইতোমধ্যেই পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়েছে, যেখানে আপনার চেহারার হালকা পরিবর্তন, কণ্ঠস্বরের ভঙ্গি, কিংবা টাইপ করার গতি থেকেই আপনার মানসিক অবস্থা নির্ধারণ করা হবে।
- Eye-Tracking Technology এখন বিভিন্ন স্মার্টফোনে সংযুক্ত হচ্ছে, যা দেখবে আপনি ঠিক কোন অংশে চোখ বেশি সময় রাখছেন।
এভাবে, ভবিষ্যতের প্রযুক্তি আপনাকে এমনভাবে চিনবে, যেন আপনার মনের গভীরতম ইচ্ছার তালিকা তার হাতে লেখা।
প্রযুক্তির আগ্রাসন:
প্রযুক্তি এগোচ্ছে এটা আনন্দের। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মানুষের স্বাধীনতা কি দিনে দিনে সংকুচিত হচ্ছে না?
স্মার্টফোনের নীরব নজরদারি আমাদের শুধু বিজ্ঞাপনের টার্গেট করছে না, বরং আমাদের চিন্তাধারাকেও প্রভাবিত করছে।
Shoshana Zuboff, বিখ্যাত লেখক ও হাভার্ড বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক, তার বই The Age of Surveillance Capitalism-এ লিখেছেন,
(আপনার অভ্যাস পরিবর্তনের জন্য, প্রযুক্তি আপনাকে কেবল বোঝেই না, বরং আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করতেও চেষ্টা করে।)
আজকের দিনে, আমরা যা দেখি, পড়ি বা বিশ্বাস করি, তা অনেকটাই নির্ধারিত হয় অ্যালগরিদমের মাধ্যমে। আপনি যা ভাবেন, তার পেছনেও কেউ একজন নিঃশব্দে স্টিয়ারিং হাতে নিয়ে বসে থাকতে পারে এটি চিন্তা করলেই গা শিউরে ওঠে, তাই না?
আমরা কি কিছু করতে পারি?
হ্যাঁ, অবশ্যই।
প্রযুক্তির সুবিধা নেব, তবে সেটাকে যেন আমাদের উপর কর্তৃত্ব করতে না দিই। এজন্য চাই সচেতন ব্যবহার।
কিছু কার্যকর পরামর্শ আবার সাজিয়ে বলি:
- পারমিশন মনিটর করুন: প্রতিটি নতুন অ্যাপ ইন্সটলের সময় জানতে চান সে কী কী অ্যাক্সেস নিচ্ছে। শুধু প্রয়োজনীয় পারমিশন দিন।
- Privacy Settings শক্ত করুন: গুগল, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদির প্রাইভেসি সেটিংস ঘেঁটে দেখুন, কোন কোন ডেটা আপনার অনুমতি ছাড়া ব্যবহার হচ্ছে।
- ভিন্ন ব্রাউজার ব্যবহার করুন: যেমন Brave, Tor, কিংবা DuckDuckGo ব্রাউজার।
- VPN ব্যবহার করুন: অনলাইন ট্র্যাকিং এড়াতে শক্তিশালী এবং নির্ভরযোগ্য VPN ব্যবহার করুন।
- নিজের অনলাইন উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করুন: প্রতিদিনের অনলাইন অভ্যাস পর্যালোচনা করুন, অপ্রয়োজনীয় অ্যাক্টিভিটি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখুন।
শেষ কথায়
স্মার্টফোন আমাদের জীবন সহজ করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই সহজতার আড়ালে যে সূক্ষ্ম ফাঁদ পাতা রয়েছে, সেটাও অস্বীকার করা যাবে না।
আপনার ফোন হয়তো সবসময় আপনার কথাগুলো সরাসরি শোনে না।
তবে আপনি কী ভাবছেন, কী চান এবং কী পছন্দ করেন, তা বোঝার খেলায় আজকের প্রযুক্তি এতটাই দক্ষ যে, আপনি নিজেও অবাক হতে বাধ্য।
তাই আজ থেকে একটু সতর্ক হন। নিজেকে তথ্যের সাগরে হারিয়ে ফেলুন না। বরং নিজের ডিজিটাল জীবনকে সচেতনতার সঙ্গে পরিচালনা করুন।
কারণ এই যুগে ডেটা-ই ক্ষমতা, আর সেই ক্ষমতা যদি নিজের হাতে না থাকে, তাহলে আপনি নিজের অজান্তেই হয়ে উঠবেন কারও টার্গেট মাত্র।
তাই নিজেকে রক্ষা করুন, নিজের স্বাধীনতাকে ভালোবাসুন।