আপনার চোখ খুলতেই যেটা প্রথম খোঁজেন, সেটা কি আপনার স্মার্টফোন? যদি উত্তরটা হ্যাঁ হয়, তাহলে আপনি একা নন। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মতো আমরাও আজ বন্দী হয়ে পড়েছি এক হাতে ধরা সেই আয়তাকার যন্ত্রটার মধ্যে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই যন্ত্রটা কি আমাদের কেবল সময় নিচ্ছে, নাকি ধীরে ধীরে আমাদের মস্তিষ্কটাকেই গিলে ফেলছে?
এই প্রশ্নটা এখন আর জল্পনা নয়। এটি এখন বৈজ্ঞানিক সত্য।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির নিউরোসায়েন্স গবেষকরা এক বিস্ময়কর তথ্য সামনে এনেছেন। স্মার্টফোন ব্যবহার করার সময় আমাদের মস্তিষ্কে নির্গত হয় ডোপামিন নামের এক রাসায়নিক, যা মূলত আনন্দ বা পুরস্কারবোধ তৈরি করে। কিন্তু এই আনন্দ হচ্ছে ক্ষণস্থায়ী, স্বল্পমেয়াদী এবং গভীরভাবে বিপজ্জনক। কারণ ডোপামিন বারবার উদ্দীপিত হলে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ি একধরনের অদৃশ্য চক্রে যেখানে আমরা স্ক্রল করি, নোটিফিকেশন চেক করি, মেসেজ খুলি এবং প্রতিবারই সামান্য এক আনন্দে আটকে যাই। একে বলে (ডোপামিন রিওয়ার্ড লুপ) একটা মস্তিষ্কবিনাশী ফাঁদ।
এটা ঠিক সেই ধরনের চক্র, যেটা আগে কেবল মাদকাসক্তদের মধ্যেই দেখা যেত। এবার সেটা এসেছে আমাদের সবার জীবনে, দিনের পর দিন।
স্মার্টফোনের একটানা ব্যবহার কীভাবে মস্তিষ্কের গঠনই বদলে দিচ্ছে?
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যদি আপনার ফোনটি কেবল পাশেই থাকে even যদি আপনি সেটা ব্যবহার না করেন তবুও আপনার মনোযোগ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। পরীক্ষায় দেখা গেছে, যাদের ফোন পাশের টেবিলে রাখা ছিল, তারা কনসেন্ট্রেশন টেস্টে খারাপ করেছে তাদের তুলনায়, যাদের ফোন অন্য রুমে ছিল।
এটা বোঝায়, শুধু ফোনের উপস্থিতিই যথেষ্ট আমাদের চিন্তাধারার গতিপথ পাল্টে দেওয়ার জন্য। মস্তিষ্ক বিভ্রান্ত হয়, মন স্থির থাকে না, এবং কাজের গতি হঠাৎ থেমে যায়।
তবে এখানেই শেষ নয়। স্মার্টফোনে অতিরিক্ত সময় কাটালে মস্তিষ্কের prefrontal cortex, অর্থাৎ সামনের অংশ দুর্বল হয়ে পড়ে। এই অংশটি আমাদের যুক্তিবোধ, আবেগনিয়ন্ত্রণ এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার কেন্দ্রবিন্দু। একে সহজ ভাষায় বলা যায় এটাই আমাদের ব্যক্তিত্ব গঠনের আসল কারখানা।
আপনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, আপনার প্রতিক্রিয়া, আপনার ভালো-মন্দ বাছাই করার জ্ঞান সবই নিয়ন্ত্রিত হয় এখান থেকে। আর প্রতিদিনের অসচেতন স্মার্টফোন আসক্তি সেই কারখানায় ছুরি চালিয়ে দিচ্ছে।
আরও ভয়ঙ্কর এক তথ্য জানলে আপনি হয়তো চমকে উঠবেন।
২০১৫ সালে মাইক্রোসফট কর্পোরেশন একটি গবেষণা প্রকাশ করে যেখানে বলা হয়, মানুষের গড় মনোযোগের সময়কাল এখন ৮ সেকেন্ডে নেমে এসেছে। এবং অবাক করার মতো তথ্য হলো, এটি একটি গোল্ডফিশের মনোযোগের সময় থেকেও কম।
এটা কি নিছক কাকতালীয়? মোটেই না। এটা সরাসরি সম্পর্কিত আমাদের হাতে ধরা সেই স্মার্টফোনের স্ক্রলিং সংস্কৃতির সঙ্গে।
অন্য সময়ের কথা বাদ দিন, এখন তো এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কোনো কিছু দেখার সময় মনোযোগ দিয়ে না দেখে আমরা just skip করে যাচ্ছি। এই দ্রুত মনোযোগ পরিবর্তনের অভ্যাস আমাদের মস্তিষ্ককে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, স্থির না থাকতে, গভীরভাবে কিছু না ভাবতে।
আর এই অভ্যাসেই তৈরি হচ্ছে এক ভয়ঙ্কর মানসিক অবস্থা: attention fragmentation মানে, আমরা এখন একটানা কোনও কিছুতে মনোযোগ দিতে পারি না। এক সময় যেই ব্যক্তি বইয়ের ৩০ পৃষ্ঠা এক বসাতেই পড়ে ফেলতে পারত, সে এখন ৩ পৃষ্ঠার পরেই বিরক্ত হয়ে ফোনের দিকে তাকায়।
ঘুম, আমাদের মস্তিষ্কের চার্জিং সিস্টেম, সেটাও বিপর্যস্ত
আপনি যদি প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে স্মার্টফোন ব্যবহার করেন, তাহলে আপনার শরীরে মেলাটোনিন নামক ঘুম আনয়কারী হরমোন সঠিকভাবে তৈরি হয় না। স্ক্রিনের নীল আলো আমাদের দেহঘড়িকে বিভ্রান্ত করে দেয়। ফলে ঘুম হয় হালকা, ছেঁড়াখোঁড়া এবং স্বাভাবিক বিশ্রামের বদলে তৈরি হয় ক্লান্তি, খিটখিটে মেজাজ এবং এক ধরনের অদৃশ্য বিষণ্ণতা।
একটা বড় পরীক্ষায় দেখা গেছে, যারা ঘুমানোর আগে ফোনে সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটায়, তাদের মধ্যে ঘুমজনিত ব্যাঘাত এবং ডিপ্রেশনের প্রবণতা অনেক বেশি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, বেশিরভাগ মানুষ এই সমস্যাকে অসুখ মনে করে না, এটা তাদের কাছে নতুন স্বাভাবিক। অথচ এটি আসলে ধীরে ধীরে চলা এক নিঃশব্দ মানসিক ধ্বংসযজ্ঞ।
তবে এখানেই শেষ নয়। স্মার্টফোন আমাদের সামাজিক সম্পর্কেও এক ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞান বিভাগ জানায়, স্মার্টফোন ব্যবহারে মানুষের সোশ্যাল ব্রেইন বা সামাজিক আচরণ সংক্রান্ত মস্তিষ্কীয় কার্যকলাপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে একজন মানুষ ধীরে ধীরে বাস্তব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এই প্রভাব বেশি। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইকের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলোকে গুরুত্ব দিতে পারে না। গবেষণায় এমনও বলা হয়েছে, অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইমের কারণে আমাদের সহানুভূতি কমে যাচ্ছে, যার প্রভাব পড়ে পরিবার, বন্ধুবান্ধব এমনকি সহকর্মীদের সঙ্গেও সম্পর্কের ওপর।
বিশেষজ্ঞরা এটিকে বলছেন ডিজিটাল আইসোলেশন সিনড্রোম। এটি এক ধরনের মানসিক অবস্থা, যেখানে একজন মানুষ চারপাশে অসংখ্য মানুষের মধ্যে থেকেও নিজেকে একা, শূন্য ও সংযোগহীন অনুভব করে। শুনে অবাক হবেন ২০১৯ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, যারা দিনে ৫ ঘণ্টা বা তার বেশি স্মার্টফোন ব্যবহার করেন, তাদের মধ্যে একাকীত্ব, বিষণ্নতা ও আত্মহত্যার চিন্তা করার প্রবণতা প্রায় দ্বিগুণ বেশি। বিশেষ করে, ইনস্টাগ্রাম বা টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মে অতিরিক্ত সময় কাটালে এই মানসিক সমস্যা আরও বেড়ে যায়।
এই অভ্যাস শুধু আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য নয়, শারীরিকভাবেও ধ্বংস করছে। চোখের সমস্যা, ঘাড়ে ব্যথা, মাইগ্রেন এসব এখন কিশোর-কিশোরীদের মধ্যেও সাধারণ সমস্যা হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে যাদের দিনের ৭-৮ ঘণ্টা মোবাইলে কাটে, তারা চোখের পাতায় শুকনোভাব, মাথাব্যথা, এবং মাঝে মাঝে ঝাপসা দেখার সমস্যায় ভোগেন। গবেষণা বলছে, দীর্ঘসময় স্মার্টফোন ব্যবহারে চোখের রেটিনাতে প্রভাব পড়ে, যার ফলে ভবিষ্যতে স্থায়ী চোখের রোগ হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে।
এখন প্রশ্ন আসে, এত সব ভয়াবহ প্রভাবের মাঝেও কি আমাদের কিছু করার উপায় আছে?
উত্তর হলো হ্যাঁ, অবশ্যই আছে। এবং সেটি শুরু করতে হবে খুব ছোট ছোট অভ্যাস থেকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দিন শুরু করার ৩০ মিনিট আগে পর্যন্ত স্মার্টফোন স্পর্শ না করা। এটা প্রথমে কঠিন মনে হলেও মস্তিষ্কের জন্য এটা বিশাল উপকার বয়ে আনে। অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গবেষকরা দেখিয়েছেন, সকালবেলায় স্ক্রিন থেকে দূরে থাকা মানুষদের মধ্যে মানসিক স্বচ্ছতা এবং ইতিবাচক মনোভাব অনেক বেশি থাকে।
একইভাবে, (ডিজিটাল ডিটক্স) শব্দটি এখন খুব পরিচিত। সপ্তাহে অন্তত একদিন অথবা দিনে নির্দিষ্ট কিছু সময় একেবারে ফোন ছাড়াই থাকা। পরিবারে একসাথে সময় কাটানো, প্রকৃতির মাঝে হাঁটা বা কিছুক্ষণ মৌন ধ্যান করা এসব খুব ছোট উদ্যোগ হলেও মস্তিষ্কের ভারমুক্তির জন্য অমূল্য। সাইবার সাইকোলজির অধ্যাপক ড. লিন্ডা ক্লাভার বলছেন, মস্তিষ্ককে সময় দিন শ্বাস নিতে। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু নিজের সাথে কাটানো ২০ মিনিটও আপনার চিন্তার ধরণ বদলে দিতে পারে।
তবে স্মার্টফোনকে একেবারে বাদ দেওয়াও বাস্তবসম্মত নয়। কারণ এটি আমাদের জীবনের প্রয়োজনীয় অংশে পরিণত হয়েছে। তাই একে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হবে, যেন ফোন আমাদের নিয়ন্ত্রণ না করে। এক্ষেত্রে (স্ক্রিন টাইম ট্র্যাকার) অ্যাপগুলো সহায়ক হতে পারে। এগুলোর মাধ্যমে আপনি জানতে পারবেন আপনি কোন অ্যাপে কত সময় ব্যয় করছেন এবং সেটি কি আপনার লক্ষ্য ও জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা।
আরেকটি চমৎকার কৌশল হলো ডিজিটাল বাউন্ডারি তৈরি করা। যেমন নিয়ম করে ঠিক করবেন, রাত ৯টার পর ফোনে কোনো সোশ্যাল মিডিয়া নয়, কিংবা খাওয়ার সময় ফোন এক পাশে রেখে খাওয়া। এতে আপনি মস্তিষ্ককে বার্তা দেন যে, কিছু মুহূর্ত আছে যা শুধুই বাস্তব জগতের জন্য।
সবশেষে আসি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটায় আপনার নিজের সচেতনতা। কারণ আপনি যদি নিজেই উপলব্ধি না করেন, তাহলে পৃথিবীর সব নিয়মই আপনার জন্য ব্যর্থ হয়ে যাবে। আপনি নিজেকে যদি জিজ্ঞাসা করেন, এই মুহূর্তে আমার হাতে ফোন না থাকলে কী হতো? কিংবা আমি কি সত্যিই এখন যা করছি, সেটা দরকারি? তাহলেই আপনি নিজেকে সামান্য হলেও রক্ষা করতে পারবেন। মনে রাখবেন, স্মার্টফোন আসলে বুদ্ধিমান নয়, আপনি বুদ্ধিমান। কাজেই সিদ্ধান্তটা আপনার।
একটু থেমে ভাবুন। এই মুহূর্তে আপনি কি আপনার জীবনের নিয়ন্ত্রণে, নাকি ছোট্ট একটা স্ক্রিন আপনার পুরো জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে?