ইউপি চেয়ারম্যানের সেতুবিলাস

ইউপি চেয়ারম্যানের সেতুবিলাস

সারাদেশ

 লিমন বাসার, বগুড়া 

2024-12-26

প্রয়োজন থাকুক আর না থাকুক, এলাকায় নতুন সেতু বা কালভার্ট তৈরিই যেন তাঁর নেশা। নিজের ইউনিয়নেই বানিয়েছেন ৩৭টি সেতু ও কালভার্ট। এমন কীর্তি যাঁর, তিনি বগুড়ার ধুনটের গোপালনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি ‘ব্রিজ চেয়ারম্যান’ নামে পরিচিত। এসব অনেক ‘মাকাল’ প্রকল্পেই অর্থায়ন করেছে সরকারের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। 
গোপালনগর ইউনিয়নে গেলেই চোখে পড়ে নানা আকারের সেতুর সমারোহ। মাত্র ১৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ ইউনিয়নে ২৭টি গ্রাম। প্রায় প্রতি গ্রামেই রয়েছে অন্তত একটি করে সেতু। চেয়ারম্যান আনোয়ারুলের নিজের গ্রাম সাতটিকুরিতে সেতুর মাত্রা আরেকটু বেশি। এ গ্রামে একটি মসজিদের সামনে ২০১০ সালের দিকে নির্মাণ করা হয় ৪০ মিটার দীর্ঘ একটি সেতু। এলজিইডির অর্থায়নে সেটি নির্মাণে খরচা হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ টাকা। তবে এ সেতু তৈরির পর এটি কোনো কাজে আসেনি। কারণ সেতুর দুই পাশে উঁচু মাটির ঢিবি। সেখানে একপাশে রয়েছে ঘরবাড়ি ও অন্যপাশে চলে চাষাবাদ। 
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আনোয়ারুল পরপর চার দফা ওই এলাকার চেয়ারম্যান। তিনি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা এবং নিজের প্রভাব জাহির করতেই এলাকায় একের পর এক সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করেন। পুকুর থেকে খেলার মাঠ কিংবা ধানিজমি– সেতু নির্মাণ থেকে কোনো জায়গা বাদ রাখেননি এ চেয়ারম্যান।

প্রয়োজনীয়তা যাচাই না করে যত্রতত্র সেতু বা কালভার্ট নির্মাণের কারণে মানুষের বিড়ম্বনাও কম হচ্ছে না। কোথাও কোথাও কালভার্ট বন্ধ করে বাড়ি বানানো হয়েছে। সদ্ব্যবহার হচ্ছে– এমন সেতু  খুব একটা চোখে পড়ে না। এলাকাবাসী ইউপি চেয়ারম্যানের এ সেতু বিলাসিতার পেছনে তাঁর বড় ভাই আতাউর রহমানের অবদানের কথা বলছেন। তিনি একসময় আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ছিলেন। তখন (২০০৩ সাল) এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল হাসানের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। সে সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে ছোট ভাই আনোয়ারুল ইসলামের পরামর্শে তিনি গোপালনগরের অনেক স্থানে সেতু নির্মাণের সুপারিশ করেন। প্রধান প্রকৌশলীর নির্দেশে গোপালনগরে একের পর এক সেতু ও কালভার্ট নির্মাণে অর্থ ব্যয় করেছে এলজিইডি। অভিযোগ রয়েছে, এগুলো নির্মাণের আগে এলজিইডির পক্ষ থেকে কখনও সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি।

স্থানীয় বাসিন্দা নুরে আলম বলেন, এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে জনচলাচল খুব একটা নেই। সেসব স্থানেও করা হয়েছে ব্রিজ কিংবা কালভার্ট। এ ছাড়া মসজিদের সামনের সেতুর নিচ দিয়ে পানি প্রবাহের কোনো ব্যবস্থা নেই। এখানে সেতুর প্রয়োজনই ছিল না। বিশাড়দিয়ার সেতুর নিচে ধান চাষ হয়। 
এলজিইডি সূত্র জানায়, ২০০৪ সালে এ উপজেলার বিশাড়দিয়ার সেতু নির্মাণ প্রকল্প ঢাকা থেকে অনুমোদন করা হয়। এর পর দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ হলেও দুর্গম এলাকা হওয়ায় তারা কাজ করেননি। পরে ২০০৯ সালে সেখানে আবার দরপত্র আহ্বান করে কাজ শুরু করা হয়। এর মধ্যে ৬৫ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৩ দশমিক ৫ মিটার প্রস্থের সেতুটির নির্মাণ খরচ ১১ লাখ থেকে বেড়ে ৪৫ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। নির্মাণের পর বেশ কয়েকবার সেতুটির মেরামত কাজও করা হয়েছে।
বিশাড়দিয়ার, চকমেহেদী, খাদিয়ামারী, সাতটিকুরী, বলারবাড়ী ও বানিয়াগাতী গ্রামে এ রকম আরও অনেক সেতু রয়েছে, সেগুলো মানুষের কোনো কাজেই আসে না। এগুলোর বেশির ভাগই কোনো সংযোগ সড়ক নেই। 

জানা গেছে, অপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণের সবই ২০০৩-০৪ অর্থবছরের। সে সময় যিনি প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন তিনি এখন অবসরে। মূলত প্রধান প্রকৌশলীর অফিস থেকেই সরাসরি বেশির ভাগ কাজের নির্দেশনা এসেছে। এ কারণে অনেক স্থানেই অপ্রয়োজনীয় সেতু হয়েছে। এখন এ সেতুগুলো এলজিইডি বিভাগের জন্য ‘গলার ফাঁস’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
ধুনট উপজেলা এলজিইডির প্রকৌশলী মনিরুল সাজ বলেন, আগের ব্রিজের ব্যাপারে সঠিক তথ্য এখন দেওয়া সম্ভব নয়। তবে পানির স্রোতধারা না থাকলে সেখানে ব্রিজ হয়নি। 
চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘এক যুগ আগের চিত্র এখনকার সঙ্গে মেলালে হবে না। অনেক স্থানে ব্রিজ-কালভার্টের আগে প্রয়োজনীয়তা ছিল, এখন হয়তো গুরুত্ব কমে গেছে। 
 

© Samakal
Shares:
Leave a Reply