ইকোনমিস্টের স্বীকৃতি এবং গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের দায় ও দায়িত্ব

ইকোনমিস্টের স্বীকৃতি এবং গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের দায় ও দায়িত্ব

মতামত

যোবায়ের আল মাহমুদ

2024-12-27

গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে যাত্রা শুরু করায় প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বাংলাদেশকে ২০২৪-এর বর্ষসেরা দেশ ঘোষণা করেছে। প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার শাসন সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রথম দিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারিগর হিসেবে পরিচিতি পেলেও ধীরে ধীরে তিনি স্বৈরাচারী শাসনের দিকে চলে যান। জালিয়াতির নির্বাচন, বিরোধী মত ও পথ দমন, ব্যাপক অর্থ আত্মসাৎ, বিরোধীদের কারাগারে নিক্ষেপ, সর্বশেষ নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলির নির্দেশের সমালোচনা রয়েছে প্রতিবেদনে। বিএনপির ‘দুর্নীতিপ্রবণতা’ এবং ইসলামী চরমপন্থার উত্থানের ব্যাপারে আশঙ্কা থাকলেও দ্য ইকোনমিস্ট অন্তর্বর্তী সময়ের পরিবর্তনকে এখন পর্যন্ত আশাব্যঞ্জক বলে মনে করে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং অর্থনীতি স্থিতিশীল করেছে বলেও পত্রিকাটির মত। 

দ্য ইকোনমিস্ট থেকে বর্ষসেরার স্বীকৃতি বাংলাদেশকে অবশ্যই নতুন করে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। এই স্বীকৃতি ছাত্র-জনতারই প্রাপ্য। গণপ্রতিরোধে দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরাচারী রেজিমের পতন ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুনর্গঠনের দিকে যাত্রা শুরু করেছে বাংলাদেশ, তা পুরো দুনিয়ার জন্যই রোল মডেল হতে পারে; যদি আমরা গণঅভ্যুত্থানের গণতান্ত্রিক অভিপ্রায় বাস্তবায়ন করতে পারি।
বর্ষীয়ান বুদ্ধিজীবী অনেকেই বলেছেন, দেশের ইতিহাসে এত বড় গণঅভ্যুত্থান আর হয়নি। এই গণঅভ্যুত্থানের আরেকটি বড় দিক হচ্ছে, খালি হাতে, নিদেনপক্ষে শুধু লাঠি আর পতাকা হাতেই ছাত্র-জনতা যেভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর নির্বিচার গুলির মুখে গণপ্রতিরোধের অসীম সাহস দেখিয়েছে, এটি বিপ্লবী ব্যাপার। সেক্যুলার ভাষায় বলা যায়, ইন্দ্রিয় সীমা অতিক্রান্ত চেতনার বহিঃপ্রকাশ কিংবা মিশেল ফুকোর ভাষায়, জনতার রাজনৈতিক স্পিরিচুয়ালিটি। এই রাজনৈতিক স্পিরিচুয়ালিটি কোনো ধর্মীয় মতাদর্শ কিংবা বামপন্থি আদর্শের জন্য নয়, বরং ডেমোক্রেটিক রেভল্যুশনের জন্য জনগণের ঐকান্তিক আত্মত্যাগ। এখানে সব মত ও পথ, সব আদর্শের লোক একত্র হয়েছে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। জনআকাঙ্ক্ষা ছিল গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, কিন্তু তা বিদেশি শক্তির ইন্ধনজাত নয়। 
ফলে ইকোনমিস্ট যে ইসলামী উগ্রপন্থার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, তা বাস্তব নয়। কারণ বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা উগ্রপন্থাকে ঠেকিয়ে দেবে। আবার এই গণঅভ্যুত্থানের কোনো বিপ্লবী মতাদর্শ ছিল না বলে অনেকে ক্রিটিক করলেও আমি মনে করি, এটি গণতান্ত্রিক যাত্রার জন্য ভালো হয়েছে। কেননা, গ্র্যান্ড মতাদর্শ বা বয়ান ফ্যাসিবাদের দিকে নিয়ে যেতে পারে বরং সমাজে ছোট ছোট বয়ান ও মতাদর্শ মনোলিথিক গ্র্যান্ড মতাদর্শকে আগ্রাসী হতে না দিয়ে একটি চেক অ্যান্ড ব্যালান্স তৈরি করতে পারে। 

দ্য ইকোনমিস্ট যেভাবে শেখ হাসিনাকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নায়ক বলেছে, তাও পুরো সত্য নয়। অর্থনৈতিক সূচক বাড়িয়ে দেখাতে অনেক ডেটা ম্যানিপুলেশন, জনসংখ্যা কমিয়ে দেখানো হয়েছে। আবার অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে আসলে যে দেশে ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে, তার হদিস হয়তো দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদক রাখেননি। 
যাই হোক, এ প্রতিবেদনে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করা হয়েছে সঠিকভাবেই। ২০২৫ সালে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন, নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ এবং বিরোধী দলগুলোর নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য পর্যাপ্ত সময়ের নিশ্চয়তা, আদালতের নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণ প্রভৃতি চ্যালেঞ্জের ব্যাপারে সরকার কী পদক্ষেপ নেয়, সেটিই এখন দেখার বিষয়।  
উল্লেখ করা দরকার, এই স্বীকৃতিতেই তৃপ্তির আস্বাদন হতে পারে না। বরং গণঅভ্যুত্থান সার্থক করতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও খাতগুলোর সংস্কার ও পুনর্গঠন এবং গণতান্ত্রিক কাঠামো দাঁড় করাতে  না পারলে দুই হাজার শহীদ এবং ৩৩ হাজার আহতের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে। রাষ্ট্র পুনর্গঠন এবং ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার বিলুপ্তি ছাড়া কেবল নির্বাচন ও ক্ষমতার স্থানান্তর আমাদের সংকট সমাধান করতে পারবে না। একটি নতুন অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন করতে হবে, যা ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে প্রতিষ্ঠিত ক্রোনি পুঁজিবাদ ধ্বংস করবে। সরকার যদি নিও-লিবারেল পলিসি থেকে সরে নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো দাঁড় করাতে না পারে তবে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের অর্থনৈতিক সুফল পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।

বাংলাদেশের বিশাল জনশক্তি বিশেষত তরুণ জনশক্তিকে কাজে লাগালে, কল্যাণমূলক নীতির আওতায় দেশি শিল্পকে সুরক্ষা ও কৃষিতে পর্যাপ্ত ভর্তুকি দিলে এবং দুর্নীতি ও অর্থ পাচার ৫০ শতাংশ রোধ করলেই অর্থনৈতিক বিপ্লব সম্ভব। এটি এ দেশের রাজনীতিবিদরা জনগণকে জানতে দেবেন না এবং তাদের অনুগত বুদ্ধিজীবীরা এসব কথা প্রচার না করে আমাদের দীনতাই বারবার শুনিয়ে যাবেন। 
বাংলাদেশের মানুষের মেধা-যোগ্যতার বিকাশে শিক্ষা কাঠামোর সংস্কার করে উচ্চশিক্ষায় বিপ্লব ঘটিয়ে বিপুলসংখ্যক গ্র্যাজুয়েটকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিতে হবে; পিএইচডি বা পোস্ট ডক্টরেট করে উচ্চশিক্ষিত ও দক্ষ ওই জনশক্তি যেন দেশেই আমেরিকা-ইউরোপের চেয়ে ভালো বেতনের চাকরি পায়, সেই সিস্টেম চালু করতে হবে। তাহলে ‘রিভার্স ব্রেন ড্রেন’ চক্র তৈরি হবে। এ জন্য উচ্চশিক্ষা কারিকুলাম আধুনিক করতে হবে। বিশ্বব্যাংক উচ্চশিক্ষার কৌশলপত্রে যে নিও-লিবারেল শিক্ষা প্রস্তাব করছে, তা বাতিল ও স্বাধীন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে।
রাষ্ট্র কাঠামোকে উদারনৈতিক বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক করার মূল ফোকাস হবে ব্যক্তি নাগরিকের সব পটেনশিয়ালের (বুদ্ধিবৃত্তিক, মানবিক, নৈতিক, আত্মিক, বৈষয়িক) বিকাশ ও সুরক্ষা। এতদিন আমরা দেখেছি কীভাবে নাগরিকদের জীবন-মেধা সব ব্যয় করা হয়েছে শাসক শ্রেণির ভোগবিলাস, লুটপাট, আরাম-আয়েশের জন্য। এখন এটি উল্টে দিতে হবে। অর্থাৎ ব্যক্তি বা জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রযন্ত্রকে নতুন করে সাজাতে হবে। এ জন্যই নতুন গঠনতন্ত্র, নতুন ক্ষমতা কাঠামো, নতুন রাজনৈতিক সুরাহা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে গত দেড় দশকে যেমন চরম নির্যাতন, নিপীড়ন হয়েছে; এসব থেকে মুক্তির তাগিদেই বিকাশ ঘটেছে স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক তরুণ শ্রেণির, যারা প্রত্যেকে এ দেশের পুরোনো প্রো-এস্টাবলিশমেন্ট বুদ্ধিজীবীদের চেয়ে এগিয়ে। এই বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণই আমাদের ভরসা। এখন দরকার স্বাধীন শিক্ষানীতি ও স্বাধীন অর্থনীতির বিকাশ। এসব সম্পন্ন করলে বাংলাদেশ খুব দ্রুতই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে ধাবিত হবে। নিজস্ব চিন্তা ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে গণতান্ত্রিক করে নতুন করে গড়ে তুলতে হবে, তবেই মুক্তির দিকে আমাদের যাত্রা শুরু হবে। দ্য ইকোনমিস্টের স্বীকৃতি দেখিয়ে দিচ্ছে, গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের সেই দায় ও দায়িত্ব তরুণদেরই।

ড. যোবায়ের আল মাহমুদ: সহযোগী অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মাসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

© Samakal
Shares:
Leave a Reply