
উদ্ভিদ নহে, ভূতের সংরক্ষণ?
সম্পাদকীয়
সমকাল ডেস্ক 2025-01-12
ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ও আগাছা হইতে ফসল সুরক্ষায় ব্যবহৃত রাসায়নিক বালাইনাশকের বাজারে সিন্ডিকেটবাজি চলিতেছে বলিয়া রবিবার সমকালের শীর্ষ সংবাদে উদ্বেগজনক চিত্র উঠিয়া আসিয়াছে। প্রতিবেদন অনুসারে, প্রায় সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর ১৫ সহস্র কোটি টাকার এই বাজার ঘিরিয়া সিন্ডিকেট যথেষ্ট শক্তপোক্ত। উহারা নিয়মনীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করিয়া অবৈধ উৎস হইতে বিভিন্ন বালাইনাশক আমদানি এবং সেইগুলি নিজস্ব মাধ্যম ব্যবহার করিয়া এমনকি প্রান্তিক কৃষক পর্যায়ে পৌঁছাইয়া দিতেছে। ফলত একদিকে সরকার বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাইতেছে, অন্যদিকে কৃষককেও চুকাইতে হইতেছে উচ্চমূল্য। উপরন্তু নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের নিয়মিত নজরদারির অভাবে ক্ষেত্রবিশেষে মানহীন বালাইনাশক ব্যবহারে ফসলের সর্বনাশ ঘটিতেছে।
প্রসঙ্গত, দেশে বালাইনাশক আমদানি, বিক্রয় ও ব্যবহারের জন্য নিবন্ধন দেয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ শাখা। নিবন্ধিত ব্র্যান্ড ব্যতীত কোনো বালাইনাশক আমদানি, বিক্রয় বা মজুতের সুযোগ নাই। কিন্তু প্রতিবেদনমতে, উদ্ভিদ সংরক্ষণ শাখা ঘিরিয়াই নানা অপকর্ম সংরক্ষিত হইতেছে। বালাইনাশকের নিবন্ধন লইতে তথাকার বিভিন্ন ঘাটে দিতে হয় নির্দিষ্ট পরিমাণ ঘুষ। অর্থাৎ উদ্ভিদ সংরক্ষণ শাখার যথায় সরিষা হইতে ভূত বিতাড়নের কথা, তথায় উহাই খোদ ভূতরূপে সমাসীন।
অধিকতর হতাশাজনক, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও বালাইনাশক লইয়া ভূতের কারবারে ক্ষান্তি নাই, বরং তাহা বর্ধমান। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদিগের অভিযোগ, নিবন্ধনের নিমিত্তে পূর্বে এক ঘাটে টাকা দিতে হইলেও এখন উহা দিতে হইতেছে ঘাটে ঘাটে। তদুপরি, পূর্বে ঘুষের হার নির্দিষ্ট না থাকিলেও এখন প্রতি পর্যায়েই ঐ অঙ্ক নির্দিষ্ট। অর্থাৎ উদ্ভিদ সংরক্ষণ শাখায় ঘুষ লেনদেনের কাচের পর্দা এখন উন্মোচিত। অধিদপ্তরের মহাপরিচালকও এই অনিয়ম সম্পর্কে যেইভাবে দায়সারা বক্তব্য দিয়া দায়িত্ব উপেক্ষা করিতে চাহিয়াছেন, উহাও যথেষ্ট সন্দেহজনক।
দেশে কীটনাশক বা বালাইনাশকের ব্যবহার লইয়া বিশেষত পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের উপর এইগুলির নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে বিতর্ক থাকিলেও, বিবিধ কারণে ফসল সুরক্ষায় এই সকল বিষ জাতীয় রাসায়নিকের ব্যবহার ক্রমশ বাড়িতেছে, ইহা আমরা জানি। অন্তত অদূর ভবিষ্যতে এইগুলির ব্যবহার বন্ধ তো দূরস্থান, হ্রাস পাইবারও সম্ভাবনা নাই বলিলেই চলে। এহেন পরিস্থিতিতে দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশের উপযোগী বালাইনাশক দেশেই উৎপাদন হইলে উত্তম হইত। উক্ত বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করিবার আরেকটা কারণ হইল, ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ঔষধ উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভ করিয়াছে। অর্থাৎ বালাইনাশক উৎপাদনের প্রযুক্তি ও পুঁজির ঘাটতি থাকিবার কথা নহে। কিন্তু প্রতিবেদনে যদ্রূপ বলা হইয়াছে, একই আমদানি সিন্ডিকেটের কারণে কোনো সরকারই অদ্যাবধি সেই লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে পারে নাই। ইহার কারণে ঔষধ শিল্প বিকাশের পর ইতোমধ্যে কয়েক দশক অতিক্রান্ত হইলেও প্রয়োজনের মাত্র ১০ শতাংশের কম বালাইনাশক দেশে উৎপাদিত হয়।
ইহা অনস্বীকার্য, যদি বালাইনাশকের সম্পূর্ণটাই দেশে উৎপাদিত হইত, তাহা হইলে ফসল উৎপাদনের ব্যয়ও লক্ষণীয় মাত্রায় হ্রাস পাইত। কারণ কৃষি উপকরণসমূহের মধ্যে অন্যতম হইল বালাইনাশক। উপরন্তু মানসম্মত বালাইনাশকে বর্তমান অপেক্ষা অধিক পরিমাণ ফসল রক্ষা সম্ভবপর হইলে উহার ইতিবাচক প্রভাবও গড় উৎপাদন ব্যয়ে পড়িত। এমনকি আমদানিতেও যদি নিয়মনীতি রক্ষা করা যাইত, তাহা হইলে ফসলের উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পাইত। উৎপাদন ব্যয় হ্রাসের সুফল যে উৎপাদক, তৎসহিত ভোক্তা পর্যায়েও পৌঁছাইত, তাহা স্বীকার না করিয়া উপায় নাই। আমরা মনে করি, যে বিষয়টির সহিত সুলভে কৃষি ও খাদ্যপণ্য সরবরাহ এবং জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার সুরক্ষা নিবিড়ভাবে জড়িত, সেই বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থা ও কর্মকর্তার চক্ষু বন্ধ রাখিবার অবকাশ নাই। স্বচ্ছ তদন্তপূর্বক দ্রুত এই বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গৃহীত হইবে– ইহাই আমাদের প্রত্যাশা।