
একটি খাল খননে ১১ বছর
প্রিয় চট্টগ্রাম
আব্দুল্লাহ আল মামুন 2025-01-19
বিশ্বে বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুয়েজ ও পানামা খাল। ১৫০ বছর আগে ১৬৪ কিলোমিটার সুয়েজ খাল খনন করতে সময় লেগেছে মাত্র ১০ বছর। বিশ্ব রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ পানামা খালও খনন করতে সময় লেগেছে ১০ বছর। এটি ১২০ বছর আগে খনন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। অথচ সাড়ে ১০ বছরে মাত্র তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি খাল খনন করতে পারেনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। এতে সিটি করপোরেশনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রতিদিন আড়াই ফুট করে খাল খনন করলেও, খালটির খনন ১০ বছরে শেষ হওয়ার কথা।
সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, অনুমোদনের ১০ বছর সাত মাস পর খালটির খননকাজ এগিয়েছে ৮০ শতাংশ। ২ দশমিক ৯৩ কিলোমিটার খালের মধ্যে দুই কিলোমিটার খনন শেষ হয়েছে। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের দাবি, শুরুতে অপর্যাপ্ত বরাদ্দ, ভূমি অধিগ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা ও মামলাসহ নানা জটিলতার কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দেরি হয়েছে। তারা প্রকল্পটি ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে শেষ করার প্রত্যাশা করছেন।
চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ১৯৯৫ সালে প্রণীত ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানে তিনটি নতুন খাল খননের সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে বহদ্দারহাটের বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন ছিল একটি। মাস্টারপ্ল্যানে থাকা এই খালটি খননের উদ্যোগ নেয় সিটি করপোরেশন। খালটি খননের জন্য প্রকল্প প্রস্তাব কর্মসূচি (ডিপিপি) তৈরি করে ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে নগরে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা তৈরি হলে ওই বছরের ২৪ জুন জাতীয় অর্থনীতি পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় বহদ্দারহাটের বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৮৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ২০১৭ সালের জুনে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও এ সময়ে কাজই শুরু করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করতে না পারায় ব্যয় বেড়েছে পাঁচগুণ। সর্বশেষ ২০২২ সালের ১৯ এপ্রিল ১ হাজার ৩৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয় অনুমোদন দেয় একনেক। তিন দফা সময় বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্প মেয়াদ ধরা হয়। এই সময়েও প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারেনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। এখন ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় হয়ে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২ দশমিক ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ খালটি হবে ৬৫ ফুট প্রস্থ। খালের দুই পাশে ২০ ফুট করে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ দুটি রাস্তা হবে এবং ছয় ফুট প্রস্থের দুটি করে ওয়াকওয়ে হবে। প্রকল্পটির ১৫ দশমিক ১৬ একর ভূমি অধিগ্রহণ কাজ শেষ হয়েছে। সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার প্রতিরোধ দেয়ালের মধ্যে ৫ কিলোমিটার, সাড়ে ৫ কিলোমিটার ড্রেনের মধ্যে চার কিলোমিটার, ৯টি ব্রিজের মধ্যে ছয়টি, ৫ দশমিক ৮ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৩ দশমিক ৮০ কিলোমিটার ও ২ দশমিক ৯৩ কিলোমিটার খালের মধ্যে ২ কিলোমিটার খাল খননকাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের দশমিক ৫০ কিলোমিটার প্রতিরোধ দেয়াল, ১ দশমিক ১ কিলোমিটার ড্রেন, তিনটি সেতু, ২ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ ও দশমিক ৯৩ কিলোমিটার খাল খননকাজ বাকি আছে। খালটির ওয়াইজরপাড়া, বলিরহাট এবং নূর নগর হাউজিং থেকে বারইপাড়া হাইজ্জারপুল পর্যন্ত খাল খননকাজ বাকি রয়েছে।
নগরের বহদ্দারহাট বারইপাড়া হাইজ্জারপুল থেকে শুরু হয়ে খালটি নূর নগর হাউজিং, ওয়াইজরপাড়া, বলিরহাটের বলি মসজিদের উত্তর পাশ দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে মিশবে। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, খাল খনন শেষ হলে পূর্ব-পশ্চিম ও দক্ষিণ শুলকবহর, চান্দগাঁও, নাসিরাবাদ, মোহরা, পূর্ব ও পশ্চিম ষোলশহর, বহদ্দারহাট, বাকলিয়া ও চাক্তাই সংলগ্ন এলাকার মোট আটটি ওয়ার্ডের ১০ লাখ বাসিন্দা জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে বলে তাদের প্রত্যাশা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৪ সালে প্রকল্পের অনুমোদন হলেও প্রকল্পটির মাঠ পর্যায়ের কাজ শুরু হয়েছে মূলত ২০২২ সালে। সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. ফরহাদুল আলম প্রকল্পটির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রকল্পটির গতি পায়।
প্রকৌশলী মো. ফরহাদুল আলম বলেন, ‘প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় অর্থছাড় হচ্ছে না। মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এছাড়া ভূমি অধিগ্রহণসহ নানা জটিলতার কারণে খাল খননকাজ দীর্ঘায়িত হয়েছে। আশা করছি, ২০২৬ সালের মধ্যে খাল খননকাজ শেষ হবে।’
বহদ্দারহাট বারইপাড়া এলাকার শিক্ষক আবদুর রহিম বলেন, ‘একটি খাল খননে ১১ বছর লাগা আজব ব্যাপার। শুধু খাল খনন নয়, সিটি করপোরেশনের সব কাজই হয় কচ্ছপগতিতে। এতে সময় আর টাকার অপচয় হয়।’