কর্মজীবী নারীর এক টুকরো স্বস্তি

কর্মজীবী নারীর এক টুকরো স্বস্তি

সমতা

লিখেছেন রাফিয়া চৌধুরী

2025-01-11

নারী যত বেশি কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন, ততই বাড়ছে ডে-কেয়ার সেন্টার বা দিবাযত্ন কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা। এখনও কর্মজীবী নারীর জন্য শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের অপ্রাপ্যতা একটি বড় সমস্যা। লিখেছেন রাফিয়া চৌধুরী

ফরিদা ইয়াসমিন। কালাচাঁদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিক হিসেবে ২০১৪ সালে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর অবসর গ্রহণের সময় ছিল ২০১৮ সালের মে মাসে। নির্ধারিত সময়ের আগে অবসর গ্রহণ করায় তিনি ৮ লাখ টাকার মতো ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ গল্পটা আমাদের সমাজে নারীর শ্রমবাজারে আসার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান সমস্যাগুলোর একটির বাস্তবতা তুলে ধরে।
২০১৪ সালে ফরিদা ইয়াসমিনের নাতনির জন্ম হয়। তাঁর ছেলে এবং ছেলের বউ দু’জনই ব্যাংকে চাকরি করেন। মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষ হওয়ার পর আমাদের সমাজে অন্য অনেক মায়ের মতো তাঁর ছেলের বউ সন্তানকে কোথায় রাখবেন, তা নিয়ে বিপত্তিতে পড়েন। তখন ফরিদা ইয়াসমিন এগিয়ে আসেন। ফরিদা ইয়াসমিন জানান– তাঁর স্বামী, মেয়ে, ছেলে সবাই তাঁকে চাকরি ছাড়তে বাধা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার চাকরি করার এখন আর বয়স নেই। প্রবীণরা যদি নবীনদের জায়গা না ছেড়ে দেন, তাহলে সমাজ এগিয়ে যাবে কীভাবে? সমাজ সংস্কার হবে কীভাবে?’ 
অন্যদিকে মুনিয়া হোসেন একটি এনজিওর প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর হিসেবে চাকরি করতেন। ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষ করে যখন চাকরিতে যোগদান করবেন, তখন সন্তান কোথায় রাখবেন। তিনি প্রথমে ভরসা করতে চান তাঁর আত্মীয়স্বজনের ওপর। মুনিয়া হোসেনের মা নেই। তারা তিন বোন। বোনেরা সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। মুনিয়া হোসেনের শ্বশুর-শাশুড়িও নেই। এর পর তিনি খোঁজা শুরু করেন কোনো গরিব আত্মীয়, যার কাছে সন্তান রেখে নিশ্চিন্তে চাকরি করতে পারেন। মুনিয়া কোনো কাজের লোকের ওপর ভরসা করতে পারছেন না। কারণ কিছুদিন আগে তাঁর এক প্রতিবেশী কাজের লোকের কাছে বাচ্চা রেখে চাকরিতে যান। বাচ্চা ক্রমেই অসুস্থ হয়ে পড়ে।
এ বাস্তবতায় মুনিয়া হোসেনের কাছে একমাত্র পথ খোলা আছে ডে-কেয়ার সেন্টার বা দিবাযত্ন কেন্দ্র। অবশেষে  ডে-কেয়ার সেন্টারে বাচ্চা রেখে তিনি চাকরিতে ফেরেন। মাসখানেক পর তিনি খেয়াল করেন, মাতৃত্বকালীন ছুটিতে থাকার সময় বাচ্চার যে ধরনের আচরণ ছিল; এখন সে অন্য রকম আচরণ করছে।  ডে-কেয়ার সেন্টার থেকে আসার পর যতক্ষণ মায়ের কাছে থাকে, সে ঝিমোয় বা ঘুমিয়ে থাকে। পরে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানা যায়, বাচ্চাকে  ডে-কেয়ার সেন্টারে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়, যেন বাচ্চা বেশি বিরক্ত না করে। এ ঘটনা জানার পর মুনিয়া চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। 
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আমাদের সমাজে বাচ্চাকে বড় করার জন্য এখনও পর্যাপ্ত  ডে-কেয়ার সেন্টার নেই। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন ও পরিকল্পনা বিভাগ) ডা. প্রকাশ কান্তি চৌধুরী জানান, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে মোট ৪৩টি ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে। এ ছাড়া সরকারি অর্থায়নে ২০টি ডে-কেয়ার সেন্টার চলছে। এসব  সেন্টারে মোট ৩ হাজার ১০০ বাচ্চার পরিচর্চা দেওয়া হয়। নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিদের বাচ্চাদের সেখানে রাখা হয়। বেসরকারি  ডে-কেয়ার সেন্টারকে একটি নিয়মের মধ্যে আনার প্রক্রিয়া চলছে। ডে-কেয়ার সেন্টারগুলোকে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে।
নারীকে অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে স্বাবলম্বী হতে হলে দরকার শ্রমবাজারে যুক্ত হওয়া। যদি সন্তানের জন্য জনগোষ্ঠীর অর্ধেক শ্রমবাজার থেকে দূরে থাকে; তাহলে সমাজের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নতি শ্লথ হয়ে পড়বে। আমাদের সমাজের অনেক মা এক সময় বাচ্চার জন্য বাধ্য হন চাকরি ছাড়তে। বাচ্চাকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে তুলতে এক সময় তারা তাদের অস্তিত্বই ভুলে যান। আবার আমাদের দেশে একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর চাকরি শুরু করা যায় না। এ ক্ষেত্রে নারীকে শ্রমবাজারে টেনে আনতে বা ধরে রাখতে  ডে-কেয়ার বা দিবাযত্ন কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান ও নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী শিরীন হক বলেন, ‘আর্থসামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে নারীকে আয়-উপার্জনের জন্য বাড়ির বাইরে যেতেই হবে। এটি নারীর ওপর এক বিশাল চাপ। নারী যেমন বাসে নিরাপদ নয়, তেমনি রাস্তাঘাটেও নিরাপদ নয়। আবার তার শিশুকে নিরাপদ জায়গায় রেখে আসার সুযোগ থাকে না বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। আগে যৌথ পরিবার ছিল। শাশুড়ি বা মায়ের কাছে শিশুসন্তানকে রেখে যাওয়া যেত। এখন সেই সুযোগ নেই। শুনেছি, অনেকে সন্তানকে বাড়িতে তালা মেরে কাজে যান। সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। আবার তালা মেরে না গেলেও ঝুঁকিপূর্ণ। মা-বাবা বাড়িতে না থাকা অবস্থায় শিশু ধর্ষণের কথা আমরা প্রায়ই শুনি। এক সময়ে সরকারি পর্যায়ে ডে-কেয়ার সেন্টার বা দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপনের কথা ব্যাপকভাবে আলোচিত হতো। নারীকে প্রাতিষ্ঠানিক কাজে যুক্ত করার জন্যই তা করা হয়। কথা ছিল দিবাযত্ন কেন্দ্র দেশব্যাপী আরও বৃহৎ পরিসরে দাঁড়াবে। তা হয়নি। বিভাগীয় শহরগুলোয় আংশিকভাবে তা করা হয়েছে। কর্মজীবী নারীর জন্য শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের অপ্রাপ্যতা একটা বড় সমস্যা।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, ‘নারীকে কর্মক্ষেত্রে শতভাগ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে অবশ্যই নারীর জন্য সহিংসতামুক্ত নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা, নিরাপদ কর্মক্ষেত্র এবং নিরাপদ পারিবারিক পরিবেশ লাগবে। যাতায়াত ব্যবস্থায় সরকারের একটি বড় দায় রয়েছে। পরিবারের সহযোগিতা এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর সহায়ক কাজের পরিবেশের জন্য আমাদের আশপাশের মানুষের মনমানসিকতা পরিবর্তনের কোনো বিকল্প নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘নারীশিক্ষার হার বেড়েছে। নারীর শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন করতে হবে। নারীর যে দুটি দায়িত্ব থাকে সংসারের কাজ এবং সন্তান লালনপালন– সেই দায়িত্বগুলো ভাগ করে নিতে হবে। সংসারের কাজ সবাই মিলে করতে হবে। সন্তান পালনের জন্য রাষ্ট্র এবং পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে। উন্নত বিশ্বে সন্তানের জন্য অনেক ডে-কেয়ার সেন্টার আছে। এই ডে-কেয়ার সেন্টারগুলো যে শুধু উচ্চবিত্তদের জন্য, এমনটা নয়। সব শ্রেণিপেশার মানুষের জন্য বিভিন্ন ধরনের  ডে-কেয়ার থাকে। সরকার এসব  ডে-কেয়ার সেন্টারে ভর্তুকি দেয়। আমাদের দেশেও সে ব্যবস্থা রাখা উচিত।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেক প্রতিষ্ঠান ও কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে। তবে শ্রমজীবী বা মধ্যবিত্ত নারীর জন্য প্রতিদিন সন্তানকে বাড়ি থেকে তৈরি করে কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া, আবার নিয়ে আসা একটা বাড়তি চাপ। যে কারণে  ডে-কেয়ার সেন্টার হওয়া দরকার অঞ্চলভিত্তিক। এতে যেমন ওই  ডে-কেয়ার সেন্টার বাড়ির কাছাকাছি থাকবে; তেমনি বাচ্চার মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রেও তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে; কারণ সে তার পরিচিত গণ্ডির মধ্যেই থাকছে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শক্তিশালী উদ্যোগ যেমন দরকার; তেমনি দেশি-বিদেশি এনজিওগুলো ভূমিকা রাখতে পারে। 

© Samakal
Shares:
Leave a Reply