গ্রামাঞ্চলে বাড়ছে ভোগান্তি  গ্রীষ্মে ভোগাবে আরও

গ্রামাঞ্চলে বাড়ছে ভোগান্তি গ্রীষ্মে ভোগাবে আরও

বাংলাদেশ

 হাসনাইন ইমতিয়াজ 

2025-01-20

অভিন্ন চাকরিবিধি বাস্তবায়ন ও চাকরি স্থায়ী করার দাবিতে বছরখানেক ধরে আন্দোলন করছেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির (পবিস) কর্মীরা। আলোচনা-বিক্ষোভের মাধ্যমে চলতে থাকা আন্দোলন গত অক্টোবরে চরম আকার ধারণ করে। বিদ্যুৎ শাটডাউনের মতো ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি সামলাতে কঠোর অবস্থানে যায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্ত, তাৎক্ষণিক বদলি ও মামলা করা হয়। শেষ পর্যন্ত সমস্যা সমাধানে সরকার পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। তবে আরইবি ও পবিসির মধ্যে এখনও দ্বন্দ্ব মেটেনি। এতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎসেবা ব্যাহত হচ্ছে। 

দ্রুত এ সমস্যা সমাধান করা না হলে গ্রীষ্মে ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা খাত-সংশ্লিষ্টদের। কারণ গরমে ঘন ঘন ট্রান্সফরমার পুড়ে, বিতরণ লাইন বিচ্ছিন্ন হয়। সময়মতো এসব দুর্ঘটনার সুরাহা না হলে গরমে দীর্ঘ সময় ভুগতে হবে গ্রাহককে। ৮২টি সমিতির মাধ্যমে ৩ কোটি ৬০ লাখ গ্রাহক তথা প্রায় ১২ কোটি জনগণকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আরইবি। 
বোর্ড ও সমিতি একীভূত করে অভিন্ন চাকরিবিধি বাস্তবায়ন এবং স্থায়ী পদের বিপরীতে চুক্তিভিত্তিক/অনিয়মিত কর্মীদের চাকরি নিয়মিত করার দাবিতে গত বছরের জানুয়ারি থেকে আন্দোলন শুরু করেন সমিতির কর্মীরা। বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু রেখে কর্মবিরতিসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন তারা। বোর্ড ও বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে একাধিক বৈঠকের পর কোনো সমাধান না হওয়ায় বিদ্যুৎ বিভাগ গত আগস্টে একটি সংস্কার কমিটি গঠন করে। সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ, আরইবির অসহযোগিতা ও বিদ্যমান সিস্টেম বহাল রাখার ইচ্ছার কারণে ওই কমিটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আগের দাবিতেই ৩০ সেপ্টেম্বর সারাদেশে মানববন্ধন এবং প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দেন পবিসের কর্মীরা। আন্দোলনকারীদের দাবি, তাদের দমাতে ১৬ অক্টোবর সমিতির ১০ কর্মকর্তাকে নোটিশ ছাড়াই চাকরিচ্যুত এবং সেদিন রাতেই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করে আরইবি। পরদিন সমিতিগুলোর বিক্ষুব্ধ সদস্যরা বিভিন্ন পবিসে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেন। এতে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে পড়ে। অনেক অঞ্চলে ৯ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন আলোচনা এবং তাৎক্ষণিক কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। এর মধ্যে আরইবি আরও ১৪ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করে। সংস্থাটির তিন মামলায় ১৭১ জনকে আসামি এবং ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। স্ট্যান্ড রিলিজ ও ওএসডি করা হয় আরও অর্ধশতাধিক কর্মীকে। গ্রেপ্তার কর্মীদের মধ্যে বর্তমানে দু’জন ছাড়া বাকিরা জামিনে মুক্ত আছেন। 
এ ঘটনার পর অন্তর্বর্তী সরকার ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৈয়দ ফারহাত আনোয়ারকে আহ্বায়ক করে ৫ সদেস্যের কমিটি গঠন করে। কমিটি ইতোমধ্যে মাঠ পর্যায়ে পবিসগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেছে। এখন আরইবির সঙ্গে আলোচনা করছে। 

সূত্র জানিয়েছে, গত নভেম্বর থেকে সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে আরইবির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল এস এম জিয়া-উল আজিম বিভিন্ন সমিতি পরিদর্শন করেন এবং কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। কর্মীদের পক্ষ থেকে মামলা প্রত্যাহার এবং চাকরিচ্যুতদের স্বপদে বহালের অনুরোধ জানানো হয়। চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে দ্রুত সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেওয়া হয়। গত ১২ ডিসেম্বর কারাবন্দি ৯ কর্মকর্তা জামিনে মুক্তি পান। পরে সমিতির পক্ষ থেকে আরইবির চেয়ারম্যানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। পরে গত ৭ জানুয়ারি চেয়ারম্যান বরখাস্ত করা কর্মীদের চাকরি পুনর্বহালের আবেদন চিঠির মাধ্যমে নাকচ করে দেন। 

আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, গত এক মাসে কয়েক ধাপে বিভিন্ন সমিতির প্রায় ৪০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে হয়রানিমূলক বদলি করা হয়েছে। সদ্য বদলি হওয়া কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির এজিএম (আইটি) জান্নাতুল ফেরদৌস প্রমি জানান,  তাঁর বাড়ি শরীয়তপুরে। আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কিছুদিন আগে তাঁকে মাদারীপুর থেকে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূরে কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট সমিতিতে বদলি করা হয়। নারী হওয়া সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানের এ আচরণ প্রতিহিংসামূলক বলে উল্লেখ করেন তিনি। 

আরইবির কেনাকাটায় দুর্নীতি
আরইবির কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। নিম্নমানের মিটার কেনার কারণে গ্রাহক প্রায়ই ভূতুড়ে বিলের শিকার হচ্ছেন। বিতরণ লাইন ও এর মালপত্র কেনাকাটায়ও সংস্থাটি অনিয়ম করে বলে জানা গেছে। মাঠ পর্যায়ের পবিসের কর্মীরা বলেন, ট্রান্সফরমার, বিতরণ লাইনের বিভিন্ন মালপত্র এতই নিম্নমানের হয় যে প্রায়ই সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। এতে গ্রাহক ক্ষুব্ধ হয়ে সমিতির লোকজনের ওপর হামলা করে। কিন্তু কেনাকাটা তো বোর্ড করে, তা গ্রাহক বোঝে না। 

সূত্র জানিয়েছে, একটি প্রকল্পের আওতায় ১১টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির পণ্য সরবরাহ করেছে দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ডব্লিউজিএল পাঁচটি ও এইচইএল ছয়টি সমিতিতে পণ্য সরবরাহ করেছে। একই প্রকল্পের আওতায় একই কাজের জন্য পণ্য সরবরাহ করলেও প্রতিষ্ঠান দুটির দামে বিস্তর ফারাক। ডব্লিউজিএল প্রতিটি কম্পিউটার ৫ লাখ ৭২ হাজার টাকায় দিয়েছে; এইচইএল সরবরাহ করেছে ৫৭ হাজার টাকায়। এভাবে প্রিন্টার, নেটওয়ার্ক রাউটার, ল্যাপটপসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ডব্লিউজিএল এইচইএলের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে আরইবিকে গছিয়ে দিয়েছে। 
সূত্র বলেছে, গত ১৫ বছরে আরইবির কেনাকাটায় এমন পুকুরচুরি হয়েছে। বিশেষ করে প্রিপেইড মিটার সরবরাহে বড় ধরনের জালিয়াতি হয়েছে। সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের আত্মীয়স্বজনের সিন্ডিকেটসহ কয়েকটি কোম্পানি মিটার, ট্রান্সফরমার ও পোল সরবরাহ করে হাজার হাজার কোটি টাকা কামিয়েছে। 
এসব বিষয়ে আরইবির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল এস এম জিয়া-উল আজিম জানান, সমিতির সমস্যা ও দাবি-দাওয়া নিয়ে সরকার গঠিত একটি কমিটি কাজ করছে। তারা যে সুপারিশ করবে, সে অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. এজাজ হোসেন জানান, আরইবির কাঠামো সেকেলে হয়ে গেছে। সংস্কার জরুরি। দেশব্যাপী লাইন বসে গেছে। এখন আরইবির কাজ অন্য বিতরণ কোম্পানির মতো শুধু বিদ্যুৎ সরবরাহ করা। তবে সংস্কারের জন্য দু’পক্ষকেই ধৈর্য ধরতে হবে। রাজনৈতিক সরকার এলে বিষয়টির কার্যকর সমাধান হতে পারে। 
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, সমিতির সদস্যরা যেমন বৈষম্যের শিকার, তেমনি আন্দোলনের কারণে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার খবর মিলছে। আরইবি আর সমিতির দ্বন্দ্ব চলতে থাকলে গরমে গ্রাহকের ভোগান্তি আরও বেড়ে যেতে পারে। 
বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, আরইবি সবচেয়ে বড় বিতরণ কোম্পানি। আমরা তার কর্মীদের উৎকণ্ঠা নিয়ে অবহিত। একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। তাদের প্রতিবেদন পেলে সরকার সে অনুসারে ব্যবস্থা নেবে। 

 

© Samakal
Shares:
Leave a Reply