
চেহারা পাল্টে সক্রিয় বালুদস্যুরা
সারাদেশ
আড়াইহাজার (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি 2025-01-11
বছরের পর বছর ধরে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার মেঘনা ও হাড়িদোয়া নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তুলে আসছে প্রভাবশালী চক্র। ইজারা না নিয়েই এভাবে চলছে দীর্ঘদিন। প্রশাসনের কর্মকর্তারা মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়েই দায়িত্ব শেষ করছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। উল্টো নদীতীরের মানুষের জমি প্রায়ই ভেঙে বিলীন হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে মেঘনায় চলাচলকারী নৌযান আটকে আদায় করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের চাঁদা। এমন চাঁদাবাজির শিকার বালুবাহী ট্রলারও।
আদায় করা চাঁদার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে লেগে থাকে সংঘর্ষও। এসব অপকর্মের প্রতিবাদে গতকাল শুক্রবার স্থানীয়দের উদ্যোগে পদযাত্রা হয়েছে। পরে এক গণসমাবেশে বালু উত্তোলনকারী চক্র ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করেছেন বক্তারা।
আ’লীগের জায়গায় বিএনপি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট দেশ ছাড়েন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই আত্মগোপনে চলে যান স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ আড়াইহাজার উপজেলা আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতারা। তাদের বেশির ভাগই এখন গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দায়ের হত্যা মামলার আসামি। এ ছাড়া আত্মগোপনে আছে আড়াইহাজার ও গোপালদী পৌরসভার মেয়র, বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতারা। জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে উপজেলার বালু উত্তোলনকারী চক্রের নেতৃত্বে ছিলেন সদ্য সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম স্বপন। তাঁর মতো আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারাই উপজেলার এই চক্র নিয়ন্ত্রণ করতেন। ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় কিছুদিন বালু উত্তোলন বন্ধ ছিল। পরবর্তী সময়ে বালু তোলা শুরু করে বিএনপি, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের প্রভাবশালী নেতারা। তাদের সিন্ডিকেট আওয়ামী লীগ নেতাদের শূন্যস্থান পূরণ করেছে বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে।
হাড়িদোয়া নদীর নিচপাড়া মোহনপুর এলাকায় বিএনপির কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার নেতৃত্বে বালু উত্তোলন চলছে। হামলা ও মিথ্যা মামলার ভয়ে এলাকাবাসী প্রতিবাদের সাহসও পাচ্ছে না। মোহনপুরের কৃষক সোহেল মিয়ার ভাষ্য, হাড়িদোয়া নদীর পাশে তাঁর প্রায় দুই বিঘা জমি রয়েছে। সেখানে মরিচ, গম, শাকসবজির চাষ করেছেন। কিন্তু প্রভাবশালী সিন্ডিকেট বালু তোলা চালিয়ে যাওয়ায় তাঁর জমিটি নদীতে বিলীন হওয়ার পথে।
এ ছাড়া কালাপাহাড়িয়া গ্রামের পূর্ব পাশের বালুচরের পশ্চিম পাশে অবস্থিত মেঘনার শাখা নদী থেকে রাতের বেলায় তোলা হচ্ছে বালু। এলাকাবাসী জানায়, কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়ন বিএনপির এক শীর্ষ নেতার নেতৃত্বে গঠিত সিন্ডিকেট এখানে জড়িত। ছোট এই নদীর দুই তীরের জমিতে বোরো চাষ করেছেন কৃষকরা। অবৈধভাবে বালু তোলায় তাদের জমিও ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। কৃষকরা জমি রক্ষায় দ্রুত বালু তোলা বন্ধে প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েছেন।
নৌপথে থামছে না চাঁদাবাজি
আড়াইহাজার উপজেলা দিয়ে বয়ে যাওয়া মেঘনা নদী দিয়ে প্রতিদিন কয়েকশ নৌযান চলাচল করে। এসব যানের বেশির ভাগেই বহন করা হয় বালু ও পাথর। বাল্কহেডে করে এসব বালু ও পাথর সিলেট থেকে কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যায়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, মেঘনা নদীর আড়াইহাজার অংশে ঢুকলেই প্রতি নৌযান থেকে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করছে বিএনপির পরিচয় দেওয়া কিছু লোক। তারা উপজেলার খাগকান্দা লঞ্চঘাট ও কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়নের বিবিরকান্দী গ্রামের পূর্ব পাশ থেকে শুরু করে কালাপাহাড়িয়া নতুনচর ও বটতলী এলাকায় ঢোকামাত্র নৌযান আটকে জোর করে চাঁদা তোলে।
কাউসার আহমেদ নামের এক চালক নিয়মিত এই পথে বাল্কহেড নিয়ে যাতায়াত করেন। তাঁর ভাষ্য, ‘টাকা না দিলে আমাদের গালাগাল, এমনকি মারধর করা হয়। টাকা না দিতে পারলে জ্বালানি তেল দিতে হয়।’
নদীপথের চাঁদাবাজির দখল নিয়ে ইতোমধ্যে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষও হয়েছে। সপ্তাহখানেক আগে খাগকান্দায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে বিএনপির দুই পক্ষ। এতে ৭ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি আলমগীর হোসেনসহ বেশ কয়েকজন আহত হন।
৫ দফা দাবিতে পদযাত্রা
হাড়িদোয়া ও মেঘনা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তোলা, দখল ও বাল্কহেডের গতিরোধ করে চাঁদাবাজি, চুরি-ডাকাতি, সন্ত্রাস, হয়রানি, নির্যাতন বন্ধের দাবিতে শুক্রবার খাগকান্দা ইউনিয়নের সচেতন নাগরিকরা পদযাত্রার আয়োজেন করেন। এদিন বিকেলে শুরু হওয়া পদযাত্রাটি মোহনপুর থেকে ইউনিয়নের খাগকান্দা লঞ্চঘাটে গিয়ে শেষ হয়। এতে নেতৃত্ব দেন পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়ন সোসাইটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইন, বৈষম্যবিরোধী আড়াইহাজারের সমন্বয়ক জোবায়ের হোসেন ও ব্যবসায়ী রুহুল আমিন।
পরে বঙ্গারবাজার এলাকায় অনুষ্ঠিত গণসমাবেশে বক্তারা বলেন, নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তোলার কারণে কৃষকের ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নৌপথে চাঁদাবাজি, চুরি-ডাকাতি, সন্ত্রাস, হয়রানি, নির্যাতন ও মাদকদ্রব্য ছড়িয়ে এলাকায় অরাজকতা ছড়িয়ে দিচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের নেতৃত্বাধীন চক্র।
জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পারভীন আক্তার বলেন, বিএনপির নাম ভাঙিয়ে কেউ অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন, চাঁদাবাজি, দখলদারি বা কোনো অপরাধ করলে দল এর দায় নেবে না। কেউ যদি অন্যায়-অনিয়ম করে, এর দায় তাকেই নিতে হবে। এসব অপরাধ শক্ত হাতে দমনে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
ইউএনও সাজ্জাত হোসেন বলেন, অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলনকারী চক্র ও নৌপথের চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের অভিযান চলছে। বুধবারও মেঘনা নদীতে তারা অভিযানে গেছেন।