
ছাত্রদের নেতৃত্ব মেনেই দল করতে চাই
রাজনীতি
এহ্সান মাহমুদ <time class="op-modified" dateTime="2025-01-16"2025-01-16
2025-01-16
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক। জুলাইয়ের ঘোষণাপত্র, নতুন রাজনৈতিক দল গঠন, সংস্কার ও সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের সহকারী সম্পাদক এহ্সান মাহমুদ
সমকাল: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ভর করে জাতীয় নাগরিক কমিটি যেভাবে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, গত চার মাসে এটি পিছিয়ে পড়ল কি? রাজনৈতিক দল ঘোষণার আগেই জনগণের কাছ থেকেও দূরত্ব তৈরি হলো কিনা?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যারা করেছেন, তারাই জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠন করেছেন, বিষয়টা এমন না। জাতীয় নাগরিক কমিটিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা যেমন অংশ নিয়েছেন, তেমনি নাগরিকরাও অংশ নিয়েছেন। নাগরিকরা অংশ নিয়েছেন ছাত্রদের নেতৃত্ব মেনে নিয়েই। সেই নাগরিকদের কোনো প্ল্যাটফর্ম ছিল না। তারা যাতে সংঘবদ্ধ হতে পারেন সেই ধারণা থেকে নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এটি এজের (বয়সের) পার্থক্য। যাদের ছাত্রত্ব থাকবে, তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনে থাকবেন, যাদের ছাত্রত্ব শেষ তারা নাগরিক কমিটিতে থাকবেন।
এবারে আন্দোলনটা যখন হয়েছিল, তখন কোনো বিভাজন বা দলীয় মতাদর্শিক লড়াই ছিল না। এ সফল আন্দোলনের পরে শেখ হাসিনার আমলে যে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাধীনতা খর্ব করে রাখা হয়েছিল, এখন তা ফিরে পেয়েছে। তারা তাদের সভা-সমাবেশ করার অধিকার ফিরে পায়। এ রাজনৈতিক দলগুলো যখন তাদের ব্যানারে ফিরে যায়, তখন দলীয় রাজনীতির বিভক্ত হওয়ার ধারাবাহিকতা আবার ফিরে আসে। আদর্শিক বিভাজনটিও ফুটে ওঠে। ফলে আন্দোলন শুরুর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের যে অবস্থান ছিল, সেটি পরে আর থাকেনি। এ আন্দোলনের পরে আমাদের একটা উপলব্ধি হয়েছে যে, তরুণ প্রজন্ম যারা আন্দোলন করেছে, তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় একটি রূপান্তর প্রত্যাশা করে। এটি উপলব্ধি করে তাদের ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা শুরু করি। তারই ফসল এখনকার জাতীয় নাগরিক কমিটি। এটি কেমন কাজ করছে সেটি ভবিষ্যতে ইতিহাসের কাঠগড়ায় বিচার হবে। আমরা ইতোমধ্যে এমন কিছু উদ্যোগ বা কাজ করেছি, যা নাগরিক কমিটি না শুরু করলে করা হতো না। ইতিহাস আমাদের সে সুযোগ দিয়েছে। সে জন্য আমরা ইতিহাসের কাছে কৃতজ্ঞ।
সমকাল: সম্প্রতি জুলাইয়ের ঘোষণাপত্র নিয়ে রাজনৈতিক মঞ্চে বেশ কথা শোনা গেল। কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়ার পরেও আপনারা ঘোষণা থেকে সরে এলেন। এটিকে কীভাবে দেখছেন?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: আমরা নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখতে পাই যে সেই সময়ে আন্দোলনের রূপরেখার একটি লিখিত দলিল আছে। এবারের হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলনের এমন কোনো লিখিত রূপরেখা নেই। শেখ হাসিনাকে হটাতে এত মানুষকে জীবন দিতে হবে, এত মানুষ আহত হবে– এটি আমরা কখনও ভাবিনি। এত বিপুলসংখ্যক মানুষ লড়াই করে জীবন দিল, আহত হলো, তারা বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়, এটির একটা দালিলিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা আমরা করছি। এটি জনমানসের মাঝে আছে। সামষ্টিকভাবে বাংলাদেশের মানুষের সামনে হাজির করার জন্যই এটি করা জরুরি। গত চার মাসে আমরা দেখিনি বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল এটির জন্য কোনো উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে এগিয়ে এসেছি। নাগরিক কমিটি বৈষম্যবিরোধী অংশের সঙ্গে আলাপ করেছে। আমরা সম্মিলিতভাবে এটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ করেছি।
সমকাল: সরকারের পক্ষ থেকে এটিকে প্রথমে ‘প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ’ বলা হয়েছিল।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন যেহেতু সরকারি দল নয়, তাই সরকার এটি বলেছে। আমরা আমাদের দায়িত্ব থেকে এটি করেছি। এই জায়গা থেকে আমরা মনে করি, সরকারের ভবিষ্যতে আরও দায়িত্বশীল আচরণ করা উচিত। নইলে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হবে।
সমকাল: গণঅভ্যুত্থানের এতদিন পরে ঘোষণাপত্র কেন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে আপনাদের কাছে?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। হয়তো এমন হতে পারে, শব্দ চয়নে কিছু পার্থক্য রয়েছে। এগুলো আমরা সমাধান করেছি। আমরা খসড়া করে ফেলেছি। জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রকাশের বিষয়ে মানুষের প্রত্যাশা জানতে ৬ থেকে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশব্যাপী জনসংযোগ করা হয়েছে। আন্দোলনের পর ছাত্র-জনতার একটি সরকার গঠন হয়েছিল। সরকারেরই ঘোষণার উদ্যোগ নেওয়ার কথা ছিল। সরকারের বিভিন্ন কাজে আমরা মন্থর গতি দেখতে পাচ্ছি। যখন ২০২৪ সাল অতিক্রান্ত হচ্ছিল, আমরা সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছি, তাদের একটি দায়বদ্ধতা রয়েছে, সে জন্য তাদের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। জুলাইয়ে একটি ঐক্যের জায়গা রয়েছে, সে জায়গায় জনগণকে সমুন্নত রাখতেই এ উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী ও বাংলাদেশের মানুষের সেখানে আসার কথা ছিল, আমরা তাদের সেখানে পাইনি। যখন জাতির একটি সংকটকাল যাচ্ছিল এবং শহীদ ও আহতের স্বীকৃতি নিয়ে কোনো ঘোষণা আসছিল না, সেই সংকট মুহূর্তে আমরা এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছি।
সমকাল: ঘোষণাপত্র ঘোষণা করা নিয়ে আপনারা কয়েকবার পিছু হটলেন। রাজনৈতিক দলগুলোর অসহযোগিতার কথাও বলেছেন আপনারা। বিষয়টি যদি পরিষ্কার করেন…
নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী: ঘোষণাপত্র নিয়ে সবার ঐকমত্য রয়েছে। রাষ্ট্রের যতগুলো অংশ এবং দেশের সব পক্ষ ও মানুষের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। দৃষ্টিভঙ্গিগত জায়গা বা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলো কীভাবে তুলে আনা যায়, সে বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের কাজ করতে একটু দেরি হয়েছে। গত ৫৩ বছর এ রাষ্ট্রকে অকার্যকর বানিয়ে রাখা হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম, সব মানুষ ও পক্ষ যাতে অংশ নিয়ে তাদের ভাষাটা প্রকাশ করতে পারে। ৫ আগস্ট আমরা যে জনতার স্রোত দেখতে পেয়েছিলাম, প্রত্যেক মানুষের কথা যেন এ ঘোষণাপত্রে থাকে; এবং যাদের দীর্ঘকালীন ন্যায্য অধিকার রয়েছে, যা নিয়ে সবাই লড়াই করছেন, প্রতিটি অধিকার যেন থাকে, সেসব বিষয় নিয়ে আমরা সবার সঙ্গে কথা বলেছি।
সমকাল: নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের অগ্রগতি কতদূর?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: সময়ের টানে বাংলাদেশে সেকেন্ড রিপাবলিকের (দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র) একটি দল আসবে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে বাংলাদেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধসে পড়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো ধসে গেছে। এই আন্দোলনে তরুণ প্রজন্ম জানান দিয়েছে, তারা এগিয়ে আসছে। সেটি নাগরিক কমিটি করুক কিংবা বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা এগিয়ে আসুক– সেটি সেকেন্ড রিপাবলিকের রাজনৈতিক দলের করতে হবে। পুরোনো রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা ও সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে নতুন রাজনৈতিক চিন্তা ও সংস্কৃতি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে হবে। আমরা নাগরিক কমিটি বলেছি, সেটি ঠিক করে দিতে আমরা সহায়তা করতে পারি।
সমকাল: এই রাজনৈতিক দলে তাহলে আপনারা থাকছেন না?
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী: জাতীয় নাগরিক কমিটি কখনও রাজনৈতিক দলে পরিণত হবে না। এখান থেকে গিয়ে কেউ রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারেন। একই সঙ্গে নাগরিক কমিটি এবং রাজনৈতিক দলের সদস্য কেউ থাকতে পারবেন না। রাজনৈতিক দল গঠনের ডাকটি মূলত বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররাই দেবেন। নাগরিকের জায়গা থেকে আমরা যেভাবে আন্দোলনে সহায়তা করেছি, সেভাবেই থাকব।
সমকাল: নতুন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে কারা থাকছেন? দলের গঠনতন্ত্রে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তার বাইরে নতুন কী থাকছে?
নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী: বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নেতৃত্ব মেনেই আমরা রাজনৈতিক দল করতে চাই। সেটি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হবে। সকল মতের মানুষকে নিয়েই আমরা এটি করতে চাই। সেখানে বিএনপি, জামায়াত করেন, এমন একজন যিনি বর্তমানে বিএনপি বা জামায়াতের রাজনীতিকে সমর্থন করছেন না, তারাও থাকতে পারেন। এ ছাড়াও সাধারণ নাগরিকের মধ্য থেকেও থাকতে পারেন। মানুষ স্বপ্নের বাংলাদেশকে যেভাবে দেখতে চায়, সেভাবে দলটিকে তৈরি করতে চাই।
সমকাল : ধন্যবাদ আপনাকে।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী : সমকালকেও ধন্যবাদ।