জলাবদ্ধতায় মিশে আছে কৃষকের কান্না

জলাবদ্ধতায় মিশে আছে কৃষকের কান্না

সারাদেশ

এম এ এরশাদ, ডুমুরিয়া (খুলনা)

2025-01-10

এক একজন কৃষকের ৬ থেকে ৬০ বিঘা পর্যন্ত আবাদি জমি। এখন সেগুলো কাজে আসছে না। চারদিকে পানি আর পানি। এক টুকরো জমিও জেগে নেই। ফসল আবাদ, মাছ চাষ সব বন্ধ। নদী-খাল স্লুইসগেট পলিতে ভরাট হয়ে গেছে। জলাবদ্ধতায় পরাস্ত কৃষক-জেলে ফসল আবাদ, মাছ ধরতে না পেরে বিল ও ডোবা থেকে শাপলা সংগ্রহ, অতিথি পাখি শিকার, কেউবা শহরে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এ চিত্র ডুমুরিয়ার বিল ডাকাতিয়ার। 
এক সময় বিল ডাকাতিয়া ছিল কৃষকের জন্য আশীর্বাদ। ধান, সবজি ও মাছ উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন সংলগ্ন বাসিন্দারা। গেল ১৫ বছরে সেই চিত্র পাল্টে গেছে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় তলিয়ে গেছে বিলের জমি। দখল দূষণের কারণে মাছও পাওয়া যায় না আগের মতো। বসতবাড়িতে পানি ওঠায় জীবন-জীবিকা দুর্বিষহ। মোটকথা, বিলটি এখন এ অঞ্চলের মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
বটবেড়া গ্রামের সমীরণ হালদারের পাঁচ বিঘা জমি রয়েছে বিলে। সেখানে ধান, মাছ, সবজি আবাদ করে বছরে ৪ লাখ টাকা আয় করতেন। ১৪ বছর সেই জমি পানির নিচে। এলাকায় কাজ নেই। সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে নোয়াখালী জেলার একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। 
মুজারখুটা গ্রামের বিধবা অঞ্জনা মণ্ডলের ডাকাতিয়া বিলে দুই বিঘা জমি রয়েছে। সাত বছর ধরে সেখানে আবাদ বন্ধ। সংসার চালাতে তিনি গৃহকর্মীর কাজ করছেন। 
একই অবস্থা রংপুর এলাকার কৃষক মনিমহন মণ্ডল, বিমল কৃষ্ণ, সাঁড়াভিটার অনিতা মণ্ডল, কার্ত্তিক মণ্ডল, পরিতোষ বালাসহ অনেকের। তারা শহরে রিকশা চালিয়ে, দিনমজুরি করে বা গৃহকর্মীর কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
ডুমুরিয়ার ২৫ নম্বর পোল্ডার এবং ফুলতলা উপজেলার কিছু অংশজুড়ে বিল ডাকাতিয়ার অবস্থান। রংপুর, ধামালিয়া, রঘুনাথপুর ও ফুলতলার জামিরা ইউনিয়নে রয়েছে সাঁড়াভিটা, বারাণসী, বটবেড়া, মুজারখুঁটা, বসিরাবাদ, কৃষ্ণনগর, গজেন্দ্রপুর, ঘোনা, দেড়ুলীসহ ৯টি বিল। বিলসংলগ্ন হরি, ভদ্রা ও হামকুড়া নদীর ৩৮ কিলোমিটারজুড়ে পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ৯টি পোল্ডারে ১০১টি স্লুইসগেটের মধ্যে ৭৫টি পলি জমে ভরাট হওয়ায় কাজে আসছে না। এসবের প্রভাব পড়েছে বিল ডাকাতিয়ায়। ১৪ মাস ধরে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ বিলের ১০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি পানির নিচে। গ্রামের অর্ধশতাধিক পরিবার পানিবন্দি। দুর্ভোগ লাঘবে নদী-খাল খনন করে টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) বাস্তবায়নের দাবি গ্রামবাসীর।  
রংপুর গ্রামের শিক্ষক কাজল বিশ্বাস বলেন, বর্ষার মৌসুমে এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকে, যা শিশুদের শিক্ষায় প্রভাব ফেলছে। জলাবদ্ধতায় অর্ধলক্ষাধিক ফলদ ও বনজ গাছ মারা গেছে। গো-খাদ্যের সংকটে প্রাণিসম্পদও হুমকির মুখে। দ্রুত বিল ডাকাতিয়া নিয়ে সমস্যার সমাধান জরুরি। 
বিল কমিটির সভাপতি প্রভাষক আমান উল্লাহ আমান বলেন, তিনটি নদীর ৩৮ কিলোমিটারজুড়ে পলি পড়ে চ্যানেলগুলো ভরাট হয়ে গেছে। নদী-খাল খননের বিকল্প নেই। নদী-খাল বিলের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি শলুয়া-পাশখালিসহ সব নদী-খালে দেওয়া অবৈধ বাঁধ ও নেটপাটা সরিয়ে ফেলতে হবে। 
খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রহমান তাসকিয়া বলেন, ডুমুরিয়া ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় শোলমারী নদীর সঙ্গে সম্পর্কিত বিল ও আবাসিক এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে ৪৯ কোটি ৭৫ লাখ ৬১ হাজার টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে সাড়ে ১৫ কিলোমিটার শোলমারী নদী খনন, ২৪টি খাল পুনঃখনন করা হবে। ১০ ভেন্টের ৪টি ও রূপদিয়া স্লুইসগেটে ৩টি উচ্চক্ষমতার পাম্প মেশিন বসানোরও পরিকল্পনা রয়েছে।  
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আল আমিন বলেন, সম্প্রতি খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ডুমুরিয়া প্রশাসন ‘বিল ডাকাতিয়া’ পরিদর্শন করেছে। ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। দ্রুত নদী-খালের পলি অপসারণ, খননসহ অন্যান্য কাজ শুরু হবে।    

© Samakal
Shares:
Leave a Reply