
ট্রাম্প আফগানিস্তানের জন্য কতটা ‘উপকারী’
মতামত
আজিজ আমিন 2024-12-27
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের পর থেকে আফগানিস্তানের ব্যাপারটি সামনে এসেছে। এ নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি কেমন হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনার মাত্রা বাড়ছে। অনেকে মনে করেন, তালেবানের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর অবস্থান নেবেন। তবে ট্রাম্পের আগের পদক্ষেপ ও বিবৃতি মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, তিনি বাস্তববাদী হিসেবে তড়িঘড়ি করে কোনো কিছু পরিবর্তন করবেন না। তা ছাড়া প্রথমবার ক্ষমতায় থাকাকালে তাঁকে হস্তক্ষেপনীতি-বিরোধী কোনো কট্টর পদক্ষেপ নিতেও দেখা যায়নি।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে দীর্ঘস্থায়ীভাবে বিদেশিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা, বিশেষত আফগানিস্তানে কয়েক দশক ধরে মার্কিন উপস্থিতির বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করেছিলেন। তিনি ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে ২০২০ সালের দোহা চুক্তির স্থপতি, যা আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পথ প্রশস্ত করেছিল। আর তা শেষ পর্যন্ত তালেবানদের ক্ষমতায় ফিরে আসার পথ প্রশস্ত করে।
দোহা চুক্তিটি আফগানিস্তানের ব্যাপারে মার্কিন কৌশল পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল। দক্ষিণ এশিয়া নীতির ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের অসন্তোষ, সামরিক উপদেষ্টাদের মধ্যে দায়বদ্ধতার অভাবজনিত কারণে হতাশ এবং ভোটের ভিত্তি ধরে রাখতে তাঁর আগ্রহ ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। ট্রাম্প দ্রুত আফগানিস্তান থেকে বেরিয়ে আসার পথে হাঁটতে শুরু করেছিলেন। কার্যত আফগানিস্তান ছাড়তে সব ধরনের প্রচলিত কৌশল ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি সংঘর্ষের অবসান ঘটাতে তালেবানদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় যুক্ত হন।
পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার পর ট্রাম্প সম্ভবত সেই পররাষ্ট্রনীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি ধরে রাখবেন, যা তাঁর অবস্থানকে জনপ্রিয় করেছে। চুক্তি হিসেবে আফগানিস্তান ও অন্যত্র ব্যয়বহুল সংঘাত ও সামরিক জটিলতার ব্যাপারে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেবেন। তালেবান নিজেই বিশ্বাস করে, ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি আগামী দিনে তাদের জন্য উপকারী হতে পারে। যেমন আফগান সরকার আশা করে, ট্রাম্পের আসন্ন প্রশাসন ‘দুই দেশের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট অগ্রগতি সামনে রেখে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেবে। আর তা উভয় দেশের সম্পর্কে নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা করতে সক্ষম হবে।’ মার্কিন নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয়ের পরপরই নভেম্বরে এক্স-এর এক পোস্টে মন্তব্যটি করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আবদুল কাহার বালখি।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চেয়ে ট্রাম্প তালেবানের সঙ্গে বাস্তবসম্মত সহযোগিতার ক্ষেত্রে বেশি উদার ছিলেন। এখন দোহা চুক্তির অংশ হিসেবে তালেবান যদি প্রতিশ্রুতি পূরণে অগ্রগতি করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ট্রাম্প হয়তো মার্কিন সহায়তা কমিয়ে দেবেন বা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বাস্তব অগ্রগতির ওপর ভিত্তি করে শর্ত জুড়ে দেবেন।
আফগানিস্তানের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য তালেবানের দখল নেওয়ার পর থেকে মার্কিন মানবিক সহায়তা সপ্তাহে প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার, যা তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন সাহায্যে যে কোনো ধরনের ঘাটতি দেশটির ভালো থাকা ও ভঙ্গুর আফগান অর্থনীতির জন্য উল্লেখযোগ্য পরিণতি বয়ে আনবে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট আরও তীব্র করবে এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও খাদ্য নিরাপত্তার অগ্রগতি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের শেষ মেয়াদের পর থেকে আফগানিস্তানের ব্যাপারে বিশ্বমঞ্চের যে মনোযোগ ছিল, তা সরে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের পর এবং ইউক্রেন ও ফিলিস্তিনের উত্তপ্ত যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আফগানিস্তান ওয়াশিংটনের বৈদেশিক নীতির এজেন্ডায় কিছুটা গৌণ হয়ে ওঠে। যে প্রেসিডেন্ট ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিতে বিশ্বাসী, তাঁকে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের সংকট মোকাবিলায় যথেষ্ট সময় ব্যয় করতে হবে। সুতরাং, ট্রাম্প আফগানিস্তানকে ইতোমধ্যে মীমাংসিত সমস্যা ছাড়া ভিন্ন কিছু হিসেবে বিবেচনা করার সম্ভাবনা খুব কম।
ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফিরে এসে তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করলে তিনি আফগানিস্তানকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সম্ভাবনা কম। এর পরও আফগানিস্তানের ব্যাপারে তিনি যে সিদ্ধান্ত নেবেন তা কেবল দীর্ঘদিন ধরে ভুক্তভোগী আফগান জনগণের জন্যই নয়, সব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ফল বয়ে আনবে। সংক্ষেপে দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পকে তাঁর আফগানিস্তান নীতিতে সফল হওয়ার জন্য বাস্তববাদী বিচ্ছিন্নতা ও বিশ্বনেতৃত্বের দায়িত্বের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য খুঁজে বের করতে হবে। আর এটাও নিশ্চিত করতে হবে, সংঘাতের অবসান করতে গিয়ে তাঁর প্রচেষ্টা যেন আরও খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি না করে।
আজিজ আমিন: অক্সফোর্ড থিঙ্কট্যাঙ্ক গ্লোবাল সোসাইটির ফেলো; আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম