
তেরো ব্যবসায়ী গ্রুপের ঋণ ৬০ হাজার কোটি টাকা
অর্থনীতি
ওবায়দুল্লাহ রনি 2025-01-20
রাষ্ট্র মালিকানার সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকে ১৩ ব্যবসায়ী গ্রুপের ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ৪০ কোটি টাকা। একক গ্রাহকের ঋণসীমা লঙ্ঘন করে বিগত সরকারের সময়ে এসব ঋণ দেওয়া হয়। এতদিন নানা উপায়ে এসব ঋণ নিয়মিত দেখানো হলেও সরকার পরিবর্তনের পর বড় অংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এতে করে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দ্রুত বেড়েছে। নতুন করে অনেকেই খেলাপি হওয়ার পর্যায়ে রয়েছে।
সরকারি ওই চার বাণিজ্যিক ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) হয় অনেক আগে। সেই আলোকে তিন মাস অন্তর এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি, ঋণ আদায়সহ বিভিন্ন বিষয়ে বৈঠক হয়। সম্প্রতি সেপ্টেম্বরভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে গভর্নরের সভাপতিত্বে বৈঠক হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা সমকালকে বলেন, রাষ্ট্রীয় ব্যাংক তদারকির আওতায় প্রতিবছর এসব ব্যাংকের সঙ্গে এমওইউ সই হয়। এমওইউর আওতায় প্রতিটি ব্যাংকে সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়নি। আগামীতে কীভাবে অগ্রগতি করা যায়, সেই বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দিক থেকে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চারটি ব্যাংকের ঋণ স্থিতি ২ লাখ ৯৭ হাজার ৬১২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। মোট ঋণের যা ৩৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। বড় ঋণগ্রহীতাদের কেউ কেউ নতুন করে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। যে কারণে ডিসেম্বর শেষের হিসাবে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে।
গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার ব্যাংকের ৫১ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকগুলোকে ধাপে ধাপে নির্ধারিত মূলধন সংরক্ষণের সুযোগ দিয়ে রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিশেষ ছাড় দিয়ে রাখা অর্থের পরিমাণ ৩৮ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। যে কারণে ব্যাংকগুলোর আর্থিক বিবরণীতে মূলধন ঘাটতি রয়েছে মাত্র ১৩ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা। চার ব্যাংকের মধ্যে এখন সবচেয়ে খারাপ অবস্থা জনতা ব্যাংকের। আর তুলনামূলক ভালো রয়েছে সোনালী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, একটি ব্যাংক একক গ্রুপকে সর্বোচ্চ কত শতাংশ ঋণ দিতে পারবে, তা নির্ধারিত আছে। বিদ্যমান নিয়মে ফান্ডেড, নন-ফান্ডেড মিলে মোট মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ ঋণ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ফান্ডেড দেওয়া যায় সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ। বাকি ১৫ শতাংশ তথা এলসিসহ বিভিন্ন দায় মেটাতে দেওয়া যায়। তবে ব্যাংকগুলো ১৩টি শিল্প গ্রুপের ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানেনি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ রয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপের। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন ব্যাংকে গ্রুপটির ঋণ ২৫ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, সরকারি চার ব্যাংকেই মূলধন ঘাটতি রয়েছে। যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ পদ্ধতিতে এসব ব্যাংকের একক গ্রাহকের সর্বোচ্চ সীমা হিসাব করে।
গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের মোট ঋণ স্থিতি ৯১ হাজার ২২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ৫৫ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা বা ৬৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ। খেলাপি ঋণের বড় অংশই রয়েছে চারটি শিল্প গ্রুপের। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকটির ১৯ হাজার ৯২৮ কোটি টাকার ছাড় তথা ধাপে ধাপে সংরক্ষণের বিশেষ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যে কারণে ঘাটতি দেখানো হয়েছে মাত্র ৬ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, একক গ্রহীতার সীমা না মেনে পাঁচ গ্রুপকে দেওয়া হয়েছে ৪২ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। মোট ঋণের যা ৪৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এককভাবে সবচেয়ে বেশি বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে যা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। গ্রুপটির ঋণ জনতা ব্যাংকের মোট মূলধনের ৯৮৭ শতাংশের বেশি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অ্যানটেক্স গ্রুপের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। মোট মূলধনের যা ৩৩৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। তৃতীয় সর্বোচ্চ এস আলম গ্রুপের ঋণ রয়েছে ৭ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা বা ব্যাংকটির মূলধনের ৩৩৫ শতাংশের বেশি। আর ক্রিসেন্ট গ্রুপকে দেওয়া ২ হাজার ৭৬ কোটি টাকা ঋণ বেশ আগ থেকেই খেলাপি। ব্যাংকটির মোট মূলধনের যা ৮৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। পঞ্চম অবস্থানে থাকা থার্মেক্স গ্রুপকে দেওয়া ২ হাজার ৩২ কোটি টাকা এখনও নিয়মিত দেখানো হয়েছে। ব্যাংকটির মোট মূলধনের যা ৮৭ দশমিক ৮০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অগ্রণী ব্যাংকে মোট ঋণ রয়েছে ৬৯ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সীমা লঙ্ঘন করে চার গ্রুপকে দেওয়া হয়েছে ৬ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা। ব্যাংকটির মোট ঋণের যা ৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি রয়েছে ১৫ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১১ হাজার ৬৯ কোটি টাকার ছাড় পাওয়ায় ঘাটতি দেখানো হচ্ছে মাত্র ৪ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। শীর্ষ চার গ্রুপের মধ্যে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপিতে পরিণত হয়েছে কেবল জজ ভূঁইয়া গ্রুপ। গ্রুপটির ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ২০১ কোটি টাকা। মোট মূলধনের যা ১০৬ শতাংশ। বসুন্ধরা গ্রুপের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। মোট মূলধনের যা ১৩০ শতাংশ। ওরিয়ন গ্রুপকে দেওয়া হয়েছে ৯৪৪ কোটি টাকা। মোট মূলধনের যা ৫২ শতাংশ। আর যমুনা গ্রুপের ঋণ রয়েছে ৮১১ কোটি টাকা, যা মোট মূলধনের ৩৯ শতাংশ।
রূপালী ব্যাংকের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সীমা না মেনে পাঁচ গ্রুপকে দেওয়া হয়েছে ৪ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। ব্যাংকটির মোট ঋণের যা ১০ দশমিক ৭৩ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির ৬ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে ছাড় রয়েছে ৪ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। শীর্ষ পাঁচ গ্রুপের মধ্যে মাদার টেক্সটাইল মিলসকে দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা। মোট মূলধনের যা ৫৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ব্লু প্লানেট গ্রুপকে দেওয়া ১ হাজার ২০৬ কোটি টাকা মোট মূলধনের ৫৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। বেক্সিমকো লিমিটেডের ৯৪৪ কোটি টাকার ঋণ মোট মূলধনের ৪১ দশমিক ৯০ শতাংশ। ওরিয়ন গ্রুপের ৮৭৬ কোটি টাকা মোট মূলধনের ৩৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ। আর মুলতাজিম গ্রুপকে দেওয়া হয়েছে ৬৯৪ কোটি টাকা। মোট মূলধনের যা ৩০ দশমিক ৮১ শতাংশ। এসব ঋণের মধ্যে কেবল বেক্সিমকোর ঋণ এসএমএ তথা খেলাপি আগের ধাপে রয়েছে।
সোনালী ব্যাংকের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৯০ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১৪ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা বা ১৬ দশমিক ২১ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বর ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি রয়েছে ২ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা। তবে ২ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা ছাড় ছিল। যে কারণে ব্যাংকটির মূলধন উদ্বৃত্ত দেখাচ্ছে। সোনালী ব্যাংকে শীর্ষ তিন গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে এককভাবে গত সেপ্টেম্বর শেষে সোনালী ব্যাংকের সবচেয়ে বেশি ঋণখেলাপি হলমার্ক গ্রুপ। গ্রুপটির ২ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। মোট মূলধনের যা ৫৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ। ব্যাংকটির মোট মূলধনের যা ৩৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। আর থার্মেক্স গ্রুপের ১ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা বা ৩২ দশমিক ৫১ শতাংশ খেলাপি।