ধানে অনীহা, চাল দিচ্ছেন কম

ধানে অনীহা, চাল দিচ্ছেন কম

সারাদেশ

স্বপন চৌধুরী, রংপুর

2025-01-17

‘রিকশা-ভ্যান দিয়ে গুদামে ধান নিয়ে যেতে বাড়তি খরচ হয়। ঠিকমতো শুকনো না হওয়াসহ নানান অজুহাতে তা ফিরিয়েও দেওয়া হয়। রয়েছে দালালের দৌরাত্ম্য। গুদামে ধান দিলে নগদ টাকা পাওয়া যায় না, ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করতে হয়। সরকারি দামের চেয়ে বাজারে দাম বেশি। পাইকাররা বাড়ি থেকে নিয়ে যান, পাওয়া যায় নগদ টাকা। এজন্য আমরা গুদামে না দিয়ে বাজারে ধান বিক্রি করছি।’ কথাগুলো রংপুরের গঙ্গাচড়ার কৃষক আহাম্মদ আলীর। 
চলতি মৌসুমে রংপুর অঞ্চলে আমন ধান ও চাল সংগ্রহ অভিযান চলছে ধীরগতিতে। ঝক্কি-ঝামেলা এড়ানোসহ বাজারে ধানের দাম বেশি হওয়ায় সরকারি গুদাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন আহাম্মদ আলীর মতো কৃষকগণ। পাশাপাশি গুদামে চাল সরবরাহে লোকসান হচ্ছে দাবি করে মিলাররাও অনীহা দেখাচ্ছেন। এতে চলতি মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ার আশঙ্কা জোরালো হচ্ছে। দুই মাসে বিভাগের আট জেলায় ধানের গড় সংগ্রহ মাত্র ৩ শতাংশ। তিন জেলায় এক কেজি ধানও সংগ্রহ হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে গঙ্গাচড়া খাদ্যগুদামে ১ হাজার ২৬৭ টন ধান ও ৬৬৬ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এ পর্যন্ত ১১২ টন চাল সংগ্রহ হলেও গুদামের জন্য এক ছটাক ধানও কেনা যায়নি। 
উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা উম্মে কুলসুম খাতুন বলেন, বাজারে দাম বেশি হওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে খাদ্যগুদামে। তারা চেষ্টা চালাচ্ছেন। ধান না পাওয়া গেলেও চাল সংগ্রহের ব্যাপারে 
তারা আশাবাদী।
রংপুর আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৭ নভেম্বর শুরু হয় আমন ধান-চাল সংগ্রহের অভিযান, চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। দুই মাসে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ধান সংগ্রহ মাত্র ৩ শতাংশ। এর মধ্যে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও পঞ্চগড়ে সংগ্রহের হার শূন্য। 
সবচেয়ে বেশি দিনাজপুরে ৭ শতাংশ, ঠাকুরগাঁওয়ে ৩, নীলফামারীতে ৬ এবং গাইবান্ধা ও রংপুরে ১ শতাংশ সংগ্রহ হয়েছে। চলতি মৌসুমে আট জেলায় আমন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৭৫ হাজার ৯৪০ টন। এ পর্যন্ত আড়াই হাজার টনের মতো সংগ্রহ হয়েছে।
আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ১৬৪ টন। এ পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে ৬ হাজার ১৬৫ টন, যা শতকরা ৩৯ শতাংশ। সেদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৩৪ হাজার ৭৫৪ টন। সংগ্রহ হয়েছে ৫৯ হাজার ৩৪ টন। শতকরা হিসাবে অর্জন ৪৮ শতাংশ। এবার চাল সরবরাহের কথা রয়েছে বিভাগের ৩ হাজার ২৩৬ জন মিলারের।
এর আগে বোরো মৌসুমে প্রতি কেজি ধানের ক্রয়মূল্য ৩০ টাকা হলেও চলতি আমন মৌসুমে তিন টাকা বাড়িয়ে ৩৩ টাকা করা হয়েছে। বোরোতে চালের কেজি ছিল ৪৪ টাকা। এবারে ৩ টাকা বাড়িয়ে ৪৭ টাকা করা হয়েছে। তারপরও তেমন সাড়া মিলছে না কৃষকের। 
তাদের অভিযোগ, খাদ্যগুদাম ১৪ ভাগ আর্দ্রতা না হলে ধান নিতে চায় না। এ কারণে গুদামে ধান দিতে গিয়েও ফিরে আসতে হয়। পাশাপাশি প্রতি টনে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দিতে হয় কর্মকর্তাদের। এর সঙ্গে রয়েছে পরিবহন ভাড়া ও শ্রমিকের চাঁদা। এর চেয়ে বাজারে ধান বিক্রিতেই লাভ বেশি।
খাদ্যগুদামে ৩৩ টাকা কেজি দরে প্রতি মণ ধানের দাম ১ হাজার ৩২০ টাকা হয় জানিয়ে পীরগাছার তাম্বুলপুর এলাকার কৃষক নওশের আলী বলেন, ৩৬ টাকা কেজি দরে বাজারে বিক্রি করা যাচ্ছে। এখন বাজারে প্রতি মণ ধান ১৪০০ থেকে ১৪৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সরকারি দরে বিক্রি করলে তাদের লোকসান গুনতে হবে।
চাল ব্যবসায়ীরাও কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা লোকসান হওয়ায় গুদামে দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন বলে জানিয়েছেন। তাদের ভাষ্য, ১৪০০ টাকা মণ দরে ধান কিনে চালে কেজিতে খরচ পড়ছে ৫০ টাকার বেশি। অথচ সরকারি গুদামে ৪৭ টাকা দরে দিতে হয়। এবার গুদামে চাল দিতে কেউ সাহস পাচ্ছেন না জানিয়ে গঙ্গাচড়ার আরাফাত অ্যান্ড রোমান চালকলের মালিক মশিউর রহমান বলেন, ‘এবার চালের বরাদ্দ পেয়েছি ১০ টন। না দিলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নসহ লাইসেন্স বাতিলের হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। বাধ্য হয়ে কেজিতে ২ টাকা লোকসানে চাল দিতে হয়েছে।’
সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ায় বাধ্য হয়ে গুদামে চাল দিতেই হবে জানিয়ে রংপুর চালকল মালিক সমিতির নেতা লোকমান মোল্লা বলেন, 
চাল সরবরাহ করে লাভ দূরের কথা, উল্টো লোকসান গুনতে হবে। না দিলে সরকার কালো তালিকাভুক্ত করবে, লাইসেন্স বাতিলসহ অন্য ব্যবস্থা নেবে। তারপরও লোকসানে চাল দিতে চাচ্ছেন না মিল মালিকরা।
এ বিষয়ে রংপুর আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক জহিরুল ইসলাম বলেন, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বাজারে ধানের দাম বেশি হওয়ায় কৃষকরা গুদামে দিতে আগ্রহী নন। মাড়াইয়ের পর তারা পাইকারের কাছে বিক্রি করতে পারছেন। আর্দ্রতা পরিমাপেরও প্রয়োজন হয় না। তাই গুদামে ধান দিতে অনীহা রয়েছে তাদের। তারপরও সময় আছে, ধান-চালের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের চেষ্টা চলছে বলে জানান এ কর্মকর্তা ।

© Samakal
Shares:
Leave a Reply