
প্রেমের ফাঁদে ফেলে গোপন ভিডিও ধারণ, টাকা আদায়
সারাদেশ
নাজমুল হাসান, গুরুদাসপুর (নাটোর) 2025-01-19
কখনও ফেসবুকে কখনও কার্যালয়ে গিয়ে পরিচয়। ধীরে ধীরে গড়ে তোলে প্রেমের সম্পর্ক। এক পর্যায়ে অসুস্থতার বাহানা করে ডেকে নেয় নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটে। তারপর আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও ধারণ করে শুরু হয় ব্ল্যাকমেইল। হাতিয়ে নেয় টাকা। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে গুরুদাসপুর উপজেলায় প্রতারণা করে আসছে কয়েকটি চক্র। সম্মানহানির ভয়ে থানায় অভিযোগ করতে চান না ভুক্তভোগীরা। যে কারণে দিন দিন বেড়েই চলছে প্রতারক চক্রের তৎপরতা।
বিষয়টি নিয়ে তিন মাস অনুসন্ধান চালিয়েছে সমকাল। গুরুদাসপুর উপজেলার প্রায় ১০ জন সরকারি চাকরিজীবী ও ৫ ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেছে। তাদের কথাবার্তায় উঠে এসেছে এই প্রতারণার তথ্য। একেকটি প্রতারণার ঘটনা যেন একেকটি নাটক-সিনেমার দৃশ্যপট। সেখানে থাকে পুলিশের অভিনয়, সাংবাদিক, কেউবা আবার গোয়েন্দা সংস্থার লোক। সেই নাটকের মূল চরিত্রে থাকে সুন্দরী তরুণী। তাদের খপ্পরে পড়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন একেকজন ভুক্তভোগী।
ভুক্তভোগীদের মধ্যে রয়েছেন গুরুদাসপুর পৌরসভার একজন কর্মকর্তাও। তাঁর ভাষ্য, প্রায় তিন মাস আগে পৌরসভার কাজকর্ম শেষ করে একটু প্রশান্তির জন্য চলনবিল বিলশা এলাকায় ঘুরতে যান তিনি। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার আগের মুহূর্তে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হবেন, ঠিক এমন সময় সুন্দরী এক তরুণী এসে সালাম দেয়। সালামের জবাব দিলে দু’জনের মধ্যে কুশল বিনিময় হয়। তরুণী তাঁকে চিনলেও তিনি চিনতেন না। তরুণী তখন বলে, তার জন্মসনদের একটু কাজ করে দিতে হবে– এই বলে ফেসবুক আইডি চেয়ে নেয়। এরপর দিনরাতে বিভিন্ন সময় মেসেজ করত। তিনিও জবাব দিতেন। কথা বলতে বলতে দু’জনের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। সম্পর্ক শুরুর প্রায় ১০ দিন পর হঠাৎ একদিন রাত ৮টার দিকে ওই তরুণী কল দিয়ে বলে, সে খুব অসুস্থ, বাসায় কেউ নেই। ওষুধ নিয়ে আসারও কেউ নেই। তাই জ্বরের ওষুধ কিনে দিতে অনুরোধ করে। মানবিক দিক চিন্তা করে ওষুধ নিয়ে ওই তরুণীর দেওয়া ঠিকানায় গুরুদাসপুর বাজার এলাকার একটি ফ্ল্যাটে যান তিনি। যাওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই প্রায় ছয়-সাতজনের একটি চক্র মারধর শুরু করে। নগ্ন করে ছবি ও ভিডিও ধারণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে একজন পরিচয় দেয় পুলিশ, একজন সাংবাদিক, গোয়েন্দা সংস্থার লোক ও স্থানীয় বাসিন্দা। কিছুক্ষণ পরে ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ২ লাখ টাকা দাবি করে। পরে অনেক চেষ্টা করে ১ লাখ টাকা দিয়ে মুক্তি পান তিনি। সম্মানহানির ভয়ে থানায় অভিযোগ দেওয়া হয়নি বলে দাবি তাঁর।
এই চক্রের খপ্পরে পড়েন উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের একজন। এই ভুক্তভোগী জানান, প্রায় পাঁচ মাস আগে এক তরুণীর সঙ্গে পরিচয় হয় নিজ কার্যালয়ে। প্রথমে বন্ধুত্ব হলেও পরে প্রেম পর্যন্ত গড়ায়। এরপর একদিন অসুস্থতার কথা বলে তাঁকে ডেকে নেয় একটি ফ্ল্যাটে। সেখানে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ছয়-সাতজনের একটি গ্রুপ তাঁকে বিব্রত করে ছবি ও ভিডিও ধারণ করে। ২ লাখ টাকা দিয়ে ছাড়া পান তিনি। এতেই শেষ হয়নি। তারপর কয়েক ধাপে বিভিন্নভাবে তাঁর কাছ থেকে আরও ১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারক চক্রটি। সম্মানহানির ভয়ে আইনের আশ্রয় নিতে চাননি তিনি।
এই চক্রের ফাঁদে পড়েন চাঁচকৈড় বাজারের এক ব্যবসায়ীও। তাঁর ভাষ্য, ফেসবুকে এক তরুণীর সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। মাঝে মধ্যেই তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এসে গল্প করে চলে যেত মেয়েটি। প্রায় ১৫ দিন কথা বলার পর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এক মাস পর তাঁকে বাড়িতে ডেকে নেয় তরুণী। তাঁর বাড়িতে যাওয়ার প্রায় ২০ মিনিট পর ৮-১০ জনের একটি চক্র তাঁকে নগ্ন করে মারধর করে। এসবের ছবি ও ভিডিও করে। পরে ৩ লাখ টাকা দিয়ে ছাড়া পান তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি এখনও রাতে ঘুমাতে পারি না। কারণ চক্রের সদস্যদের কাছে আছে সেই ভিডিও। কখন জানি আবার টাকা দাবি করে কিংবা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়।’ তিনিও আত্মসম্মানের ভয়ে থানায় অভিযোগ দেননি।
প্রতারকের খপ্পরে পড়েন রুহুল আমিন (ছদ্মনাম) নামে একজন। এ ঘটনায় চক্রের ১৮ সদস্যের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা করেন তাঁর ছেলে। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন– নারায়ণপুর গ্রামের রাসেল ইসলাম, সাবিদুল ইসলাম ও মিঠুন শেখ। রাসেলের বিরুদ্ধে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ছিনতাইসহ হত্যা মামলা রয়েছে। কারাগারে রয়েছেন তারা।
ভুক্তভোগী জানান, গত মঙ্গলবার গুরুদাসপুর সরকারি পাইলট হাইস্কুল মাঠে ওয়াজ মাহফিলে যান তিনি। সে সময় চক্রের এক নারী সদস্যকে দিয়ে তাঁকে অপহরণ করে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে নিয়ে যায়। ওই নারীর সঙ্গে তাঁকে আপত্তিকর অবস্থায় রেখে ভিডিও ধারণ করে। ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ চায় অভিযুক্তরা। টাকার জন্য তাঁর ছেলেকে ফোন করলে সে পুলিশের শরণাপন্ন হয়। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে।
গুরুদাসপুর থানার ওসি গোলাম সারওয়ার হোসেন বলেন, ইতোমধ্যে চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ১৮ জনের নাম বলেছে তারা। আদালতে রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। রিমান্ড মঞ্জুর হলে জিজ্ঞাসাবাদে আরও তথ্য পাওয়া যেতে পারে। তাঁর দাবি, নির্দিষ্টভাবে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ দিলে দ্রুত এসব চক্রকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা যায়। তারপরও পুলিশ প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করছে।
ইউএনও ফাহমিদা আফরোজের ভাষ্য, যারা ফাঁদে পা দিচ্ছেন তাদের আরও সচেতন হতে হবে। যেসব ভুক্তভোগী ভয়ে বা সম্মানহানির ভয়ে আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন না, তারা ভুল করছেন। সাহস করে পরিচয় গোপন রেখেও চক্রের বিরুদ্ধে তথ্য দিলে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারে।