বর্জ্য থেকে কম্পোস্ট সার

বর্জ্য থেকে কম্পোস্ট সার

কিছু আলো নীল

 আসাদুজ্জামান, কুষ্টিয়া থেকে ফিরে

2025-01-10

পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দেশের অপরাপর পৌরসভাগুলো যেখানে ভর্তুকি দিচ্ছে, সেখানে ব্যতিক্রম কুষ্টিয়া পৌরসভা। স্যানিটেশন উপ-আইন প্রণয়ন এবং সেই উপ-আইনের আলোকে পথ চলার মাধ্যমে পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনার এ খাত থেকে উল্টো আয় করছে তারা। কুষ্টিয়া পৌরসভা পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ মল সংগ্রহ, পরিবহন, পরিশোধন এবং পুনঃব্যবহার বা অপসারণের প্রতিটি ধাপে বাণিজ্যিকভাবে কাজ করছে। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পিট এবং সেপটিক ট্যাঙ্ক খালি করাকে প্রাধান্য দিয়ে এবং দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া পরিবারকে বিবেচনায় রেখে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। পৌরসভার সরকারি ও বাণিজ্যিক ভবনে আরোপ করা হয়েছে স্যানিটেশন ট্যাক্স। পৌর পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য পৌরসভা কর্তৃক নিয়োজিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চৌড়হাঁস ফুলতলা কল্যাণ সমিতি (সিএফসিএস) এবং এরাস কাজ করছে। এ কাজে সম্পৃক্ত হয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দুটি চুক্তি অনুযায়ী পৌরসভাকে যেমন বার্ষিক ভিত্তিতে অর্থ প্রদান করছে, তেমনি নিজেরাও ব্যবসা করে লাভবান হচ্ছে। পয়োবর্জ্য পরিশোধন করে তৈরি করা হচ্ছে কম্পোস্ট সার। সে সার পরিবেশবান্ধব হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে কৃষিজমিতে।
এ উদ্যোগের মূলে রয়েছে ‘কুষ্টিয়া পৌরসভা স্যানিটেশন উপ-আইন, ২০২০’। স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯-এর ১২২ ধারার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে কুষ্টিয়া পৌরসভা ‘কুষ্টিয়া পৌরসভা স্যানিটেশন উপ-আইন ২০২০’ প্রণয়ন করে। এর সফল প্রয়োগের লক্ষ্যে ‘কুষ্টিয়া পৌরসভা স্যানিটেশন ভিশন ২০২৭’ নামে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করছে। বিল অ্যান্ড মিলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এবং  নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের অর্থায়নে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা এসএনভি নেদারল্যান্ডস ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের সার্বিক সহযোগিতায় কুষ্টিয়া পৌরসভা উপ-আইন তৈরি এবং বাস্তবায়ন করে নগরবাসীর জন্য টেকসই পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও স্যানিটেশন সেবা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
এই উপ-আইন বিষয়ে কথা হয় কুষ্টিয়া পৌরসভার কর্মকর্তাদের সঙ্গে। তারা জানান, শুরুতে বাসাবাড়ি থেকে বিনামূল্যে পয়োবর্জ্য সংগ্রহ করা হলেও এখন নগরবাসী নির্ধারিত সেবামূল্য দিয়ে সেবাটি নিতে পারছেন। পৌরসভার ট্যাক্স প্রদানকারী সব নাগরিক এ সুবিধার অন্তর্ভুক্ত।
সরাসরি কথা হয় বর্জ্য সংগ্রাহক রতনের সঙ্গে। তিনি জানান, স্বাস্থ্য সুরক্ষা পোশাক পরে এবং কোনো ময়লা স্পর্শ না করে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে অল্প সময়েই বাসা থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রতিদিন ৫টি গাড়িতে ১৬ থেকে ২০টি বাড়ির বর্জ্য সংগ্রহ করেন তারা।
এ সময় পাশে দাঁড়িয়ে কাজ দেখছিলেন সেবা গ্রহণকারী মাবিয়া খাতুন। তিনি জানান, সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কারের বিষয়টি নিয়ে আগে অনেক ঝামেলায় পড়তে হতো। এখন সেই ঝামেলা নেই। পৌরসভায় আবেদন করি। এরপরই তারা পরিষ্কার করে নিল। এ সময় পয়োবর্জ্য পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠান সিএফসিএসের ম্যানেজার মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, একটি সুশৃঙ্খল পদ্ধতির মাধ্যমে পয়োবর্জ্য সংগ্রহের পর এটি ট্রিটমেন্ট প্লান্টে যায়। সেখান থেকে প্রসেস হয়ে সার হিসেবে আবার মানুষের কাছে ফিরে আসে।
কুষ্টিয়া কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে দেখা যায় স্যানিটেশন উপ-আইনের মাধ্যমে নির্মিত হয়েছে পাবলিক টয়লেট। নারী, পুরুষ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ সব মানুষ সেখানে যেতে পারছে এবং নিরাপত্তা-গোপনীয়তার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এখানে নারীরা প্রয়োজনে স্যানিটারি প্যাড কিনে নিতে পারবেন। একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে এটি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।
সুরাইয়া আক্তার ও মেয়ে সোমা আক্তার খুলনার বাসযাত্রী– পাবলিক টয়লেট থেকে বের হলে কথা হয় তাদের সঙ্গে। তারা জানান, দীর্ঘ সময় বাসের অপেক্ষায় থাকতে হয়। এ সময় ওয়াশরুম খুব দরকার। বেশির ভাগ বাস টার্মিনালে নারীর জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা থাকে না। এখানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং আলাদা ব্যবস্থা থাকায় খুব ভালো লাগল। অনেক শহরে গিয়েছি, কোথাও এমন পরিবেশ পাইনি।
পাবলিক টয়লেট দেখে আমাদের গন্তব্য শহর থেকে একটু দূরে পয়োবর্জ্য ট্রিটমেন্ট প্লান্ট। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত ধাপ; যার মাধ্যমে কর্মসংস্থান হয়েছে অনেকের। কথা হয় প্লান্টের ব্যবস্থাপনায় থাকা এরাস ভেঞ্চার লিমিটেডের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট পরিচালক ঈশা হকের সঙ্গে। তিনি জানান, এখানে পয়োবর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে তৈরি জৈব সার সারাদেশের কৃষকের হাতে পৌঁছায়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট দুই বছর গবেষণা করে দেখেছে, এই জৈব সার মাটি এবং ফসলের জন্য উপকারী। এই সারের চাহিদা অনেক। সেই অনুযায়ী সরবরাহ করতে পারছি না। আর্থিক সহযোগিতা ও ইকুইপমেন্ট পেলে বড় আকারে উৎপাদন করা যেত।
সামগ্রিকভাবে এ উপ-আইন প্রয়োগের মধ্য দিয়ে কুষ্টিয়া পৌরসভার পরিবেশবান্ধব স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়নের ধারা চলমান রয়েছে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড মেনে এবং পৌরসভা অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী পৌরবাসী সেপটিক ট্যাঙ্ক তৈরি করছেন। কুষ্টিয়া পৌরসভা বিল্ডিং ডিজাইনার এবং রাজমিস্ত্রিদের তালিকাভুক্ত করে তাদের সম্পৃক্ত করেছে। স্যানিটেশন কর্মীদের জন্য পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তাবিষয়ক নির্দেশিকা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করছে কুষ্টিয়া পৌরসভা। সার্বিকভাবে ‘কুষ্টিয়া পৌরসভা স্যানিটেশন উপ-আইন, ২০২০’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নগরবাসীর জন্য একটি টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক পয়োবর্জ্য ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নীতকরণ সম্ভব হচ্ছে। v

© Samakal
Shares:
Leave a Reply