বিলাসের ‘বিবর্ণ প্রতীক’

বিলাসের ‘বিবর্ণ প্রতীক’

প্রিয় চট্টগ্রাম

 বিপুল দাশ, মিরসরাই

2025-01-11

বাড়ির সামনে বড় খেলার মাঠ। মাঠের দক্ষিণ পাশে মাটির তৈরি চৌচালা গুদামঘর। ঘরটি দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে জীর্ণ। জং ধরা টিন ও গাছের খিলান নষ্টপ্রায়। মাটির তৈরি মোটা দেয়ালও ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। এটির নাম কাচারি ঘর। একটা সময় আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ঘরটিতে চলত নানা কর্মকাণ্ড। চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা। মিরসরাইয়ের ছড়ারকুল গ্রামের ফরেস্টার বাড়ির কারাচি ঘরটি জৌলুস হারিয়ে এখন বিবর্ণ বিলাসের প্রতীক। অথচ একসময় গ্রামীণ জনপদে কাচারি ঘর ছিল শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামাজিক আয়োজন ও নির্বাচনী প্রচারণার কেন্দ্র।
তবে এখনও গ্রামের কোথাও কোথাও দুই-একটি কাচারি ঘরের দেখা মেলে। সরেজমিন ঘুরে এমন একটি ঘরের দেখা মিলল উপজেলার নন্দনপুর গ্রামের চৌধুরী বাড়িতে। বাড়ির প্রবীণ সদস্য আবু সুফিয়ান চৌধুরী জানান, তাদের কাচারি ঘরটির বয়স ১০০ বছরের বেশি। পড়াশোনার হাতেখড়ি এই ঘরেই। বাড়ির গৃহশিক্ষকও থাকতেন এখানে। সকালবেলা মক্তব বসত কাচারি ঘরে। দিনের বেলায় হতো সালিশ-বিচার।
আবু সুফিয়ান চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের বাড়ির কাচারি ঘরটির গুরুত্ব বেশি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের জন্য। যুদ্ধের শুরুর দিকে এ ঘর ছিল বহু মানুষের আশ্রয়কেন্দ্র। তখন দিনরাত রান্না হতো। দূরদূরান্ত থেকে এসে এখানে আশ্রয় নিত মানুষ। বিপদগ্রস্ত মানুষের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও হতো এখানে। গত ১০০ বছরে কয়েক দফা সংস্কার করে এখনও কোনোমতে টিকিয়ে রাখা হয়েছে ঘরটিকে।’
ছড়ারকুল গ্রামে ফরেস্টার বাড়ির বাসিন্দা সালাউদ্দিন জানান, তাদের কারাচি ঘরের বয়সও শত বছরের কম হবে না। তাঁর পূর্বপুরুষরা কারাচি ঘর ব্যবহার করে সমাজের নানা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। এখন বাড়ির সদস্যরা অনেকেই দেশ-বিদেশে কর্মজীবন পার করছেন। ফলে পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া এ ঘর দীর্ঘদিন সংস্কার করা হয়নি। সংস্কারের অভাবে এখন এটি প্রায় ভেঙে পড়েছে।
কাচারি ঘর তৈরি হতো নানাভাবে। কোনো ঘর হতো ইট-সুরকির ছোট দালান।
কোথাও খড় বা টিনের চালায়, বাঁশের বেড়া বা মাটির দেয়ালে তৈরি হতো কাচারি ঘর। ঘরের ভেতরে পাতা থাকত পোক্ত গাছের চৌকি, চেয়ার-টেবিলসহ নানা ধরনের আসবাব। প্রশস্ত দরজা-জানালার এ ঘর প্রাণ জুড়াত সবার। সালাউদ্দিন বলেন, ‘কাচারি ঘরে গৃহশিক্ষক থাকতেন, গৃহস্থের সন্তানদের পড়াতেন, এলাকার সালিশ বিচার হতো। আবার এটি অতিথিশালা, মক্তব, পাঠাগার ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হতো।’ বাঙালির শিক্ষা-সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে কাচারি ঘরের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। কাচারি ঘরে বসত জারিগান ও পুঁথিপাঠের আসর, খোশগল্পের মজলিস। বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, বাংলায় কাচারি শব্দটির প্রচলন সতেরো শতকে। সম্ভবত হিন্দি বা মারাঠি ভাষা থেকে উদ্ভূত হয়ে বাংলায় প্রচলিত হয় কাচারি শব্দটি। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলার বারো ভূঁইয়ার একজন ঈশা খাঁর আমলে কর্মচারীরা বাড়ির দরজায় অবস্থিত কাচারি ঘরে বসে খাজনা আদায় করতেন। ১৭৬৫ সাল থেকে জমিদারি দপ্তর ও সব রাজস্ব কার্যালয় কাচারি নামে পরিচিতি পেতে শুরু করে। ২০ শতকের শুরুর দিকের সাহিত্যে সরকারি, জেলা, জমিদারি, মহাজনি ও বানিয়া কাচারি প্রভৃতি নামের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
মিরসরাইয়ে পাড়া আর গ্রামে কিছু বনেদি বাড়ির সামনে এখনও কাচারি ঘর চোখে পড়ে। তবে বেশির ভাগ সংস্কারহীন, জীর্ণ, আধভাঙা। মিরসরাইয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি ডা. জামশেদ আলম বলেন, ‘একসময় আমাদের অঞ্চলে কাচারি ঘর ছিল মর্যাদার প্রতীক। যে বাড়ির সামনে কাচারি ঘর ছিল, সে বাড়ির আলাদা মর্যাদা ছিল। কারাচি ঘরের সাথে মানুষের সোনালি অতীত মিশে আছে। কিন্তু আজ বিলুপ্তির পথে কাচারি ঘর।’

© Samakal
Shares:
Leave a Reply