মুক্তিযুদ্ধের অবিনশ্বর নক্ষত্র

মুক্তিযুদ্ধের অবিনশ্বর নক্ষত্র

মতামত

আব্দুল্লাহ যোবায়ের

2025-01-19

জিয়াউর রহমান ছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগণ্য সেনানায়ক। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনার গাড়িগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সকে টার্গেট করে এগিয়ে আসছিল। সে রাতেই তারা পরিচালনা করে ইতিহাসের নৃশংস গণহত্যা। এমন পরিস্থিতিতে জাতি যখন দিশেহারা, তখন মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী থেকে বিদ্রোহ করেন সময়ের সাহসী বীর তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান। 

ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর অপারেশনের খবর পেয়ে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে জিয়াউর রহমান তাঁর কমান্ডিং অফিসারসহ অন্যান্য পাকিস্তানি অফিসার ও সৈন্যকে বন্দি করেন। পরদিন ২৬ মার্চ প্রাণভয়ে পলায়নপর মানুষকে থামিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্দীপনাময় ভাষণ দিতে শুরু করেন মেজর জিয়া। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিনি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে নিজ কণ্ঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ২৭ মার্চ সারাদিন ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের’ পক্ষে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা বারবার প্রচার হতে থাকে। মুক্তিকামী জনতা নতুন উদ্দীপনায় ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিসংগ্রামে। শুরু হয় ৯ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ।

মেজর জিয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ১১ সেক্টর কমান্ডারের একজন ছিলেন। ৪৯ জন যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধাকে ১৯৭২ সালে সরকার সর্বোচ্চ বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত করে। তিনি তাদের একজন ছিলেন। কিন্তু তিনি সেক্টর কমান্ডার ও বীরউত্তম খেতাবধারীদের মধ্যেও অনন্য ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে।
মেজর জিয়া চট্টগ্রাম যুদ্ধাঞ্চলে ১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক এবং পরে জেড ফোর্সের প্রধান হিসেবে বহু আলোচিত যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। যুদ্ধের শেষভাগে সিলেট অঞ্চলে তাঁর বাহিনীর কাছেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী যুদ্ধে তাঁর বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম শক্তিশালী প্রভাবকের ভূমিকা রেখেছে। কিছু ক্ষেত্রে তাঁকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে।
জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। প্রথমত, শক্তিশালী সম্প্রচার কেন্দ্রে বারবার সম্প্রচারিত হওয়ার ফলে জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণাটিই কেবল দেশের সব অঞ্চল থেকে বহু মানুষ শুনতে পেয়েছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর আক্রমণের মুখে দিশেহারা ও পলায়নপর অবস্থায় এটি মানুষের কাছে তূর্য ধ্বনির মতো উদ্দীপনা 
সৃষ্টি করে।

দ্বিতীয়ত, জিয়ার ঘোষণাটি ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন বিদ্রোহী বাঙালি অফিসারের এবং বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে। এটি মানুষকে প্রতিরোধের সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রবলভাবে আশান্বিতও করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানীর নির্দেশে অক্টোবর মাসে পুরো জেড ফোর্স নিয়ে মেজর জিয়া চলে আসেন সিলেটে। এর তিনটি ব্যাটালিয়ন শ্রীমঙ্গল, ছাতক ও কুলাউড়ায় অবস্থান নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনা ও ক্যাম্পে সরাসরি হামলা চালায়। ১০ ডিসেম্বর এই ফোর্স সিলেট আক্রমণ শুরু করে। ১৪ তারিখ তারা সিলেটে প্রবেশ করে। যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে তিনি একদিন বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন; সিলেটে ১২৫ জন অফিসার, ৭০০ সৈন্যসহ সেই বাহিনীর একটি অংশ তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদান ছিল অপরিসীম। স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া ছাড়াও যুদ্ধ পরিচালনা ও যুদ্ধ প্রশাসনের নীতিনির্ধারণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন মুক্তিযুদ্ধের সময়। জিয়া ছিলেন এই যুদ্ধে মহানায়কের মতো। আরও ছিলেন খালেদ মোশাররফ, আবু তাহের, আবু ওসমান, এমএ জলিল, রফিকুল ইসলামসহ অন্যান্য সেক্টর কমান্ডার।
মুক্তিযুদ্ধ সর্বোপরি ছিল একটি জনযুদ্ধ; বহু সাধারণ মানুষের অসাধারণ আত্মত্যাগ আর শৌর্য-বীর্যের এক অনুপম গৌরবগাথা।

মেজর জিয়াউর রহমান আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের এমনই এক অবিনশ্বর নক্ষত্র। আজ জন্মদিনে তাঁকে আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। 

আব্দুল্লাহ যোবায়ের: শিক্ষক ও গবেষক

© Samakal
Shares:
Leave a Reply