
মূল্যস্ফীতির অগ্নিতে করের ঘৃত
সম্পাদকীয়
সমকাল ডেস্ক 2025-01-11
অর্থবৎসরের মধ্যভাগে আসিয়া শতাধিক পণ্য-সেবার উপর ভ্যাট, সম্পূরক ও আবগারি শুল্ক বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর ঘোষণা করিয়াছে উহা শুধু অপ্রত্যাশিত নহে, বিশেষত নিম্নআয় ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জন্য একপ্রকার দুঃসংবাদও বটে। শনিবার প্রকাশিত সমকালের এক সংবাদ অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার সরকার দুই পৃথক অধ্যাদেশ জারি করিয়া এমন কিছু পণ্য ও সেবার শুল্ক-কর বাড়াইয়াছে যেইগুলির মধ্যে রহিয়াছে– রেস্তোরাঁ, ঔষধ, কোমল পানীয়, সাবান, ডিটারজেন্ট, বিস্কুট, ফল, জুস ও পোশাকের ন্যায় বহুল ব্যবহৃত পণ্য এবং টেলিফোন, ইন্টারনেট ও এলপি গ্যাসের ন্যায় আবশ্যকীয় সেবা। এই সিদ্ধান্তের কারণে শুধু সংশ্লিষ্ট পণ্য ও সেবার ব্যয় বৃদ্ধি পাইবে না, সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির আগুনেও ঘি ঢালিবে। ফলস্বরূপ নিম্নআয় তো বটেই, সাধারণ মধ্যবিত্তেরও জীবনে নাভিশ্বাস উঠিবে। স্মরণ করা যাইতে পারে, নানা কারণে বিশেষত বিগত তিন বৎসর নিত্যপণ্যের বাজার ছিল রীতিমতো ‘পাগলা ঘোড়া’। দামের চোটে বছরজুড়িয়া গড় মূল্যস্ফীতি ছিল দুই অঙ্কের ঘরে। অন্যদিকে উক্ত সময়ে মানুষের রোজগার বাড়ে নাই, উল্টো অনেকে চাকরি হারাইয়া বেকারত্বে ধুঁকিতেছেন, বিশেষত বেসরকারি চাকুরিজীবীদের বৃহৎ অংশ বেতন-ভাতা সংকোচনের শিকার হইয়াছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রম জরিপের তথ্য বলিতেছে, চলতি অর্থবৎসরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বেকারের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৭ লক্ষ, যাহা এক বৎসর পূর্বের একই সময়ে ছিল ২৫ লক্ষের কিছু কম। অর্থাৎ এক বৎসরে বেকার বাড়িয়াছে দেড় লক্ষাধিক।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাসকিন আহমেদ বলিয়াছেন, শুল্ক বৃদ্ধি করিলে উৎপাদন ব্যয় বাড়ে। ফলে অনেক ব্যবসায়ীর পক্ষে প্রতিযোগিতামূলক দাম রাখা কঠিন হইয়া পড়ে, বিশেষত যদি তাহারা আন্তর্জাতিক বাজারের সহিত যুক্ত থাকে। তদুপরি, উচ্চ শুল্ক-কর ব্যবস্থার কারণে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হইতে পারেন। নতুন প্রকল্পে, বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগ হ্রাস পাইতে পারে, কর্মসংস্থানের উপর যাহার নেতিবাচক প্রভাব স্বাভাবিক। ভোক্তার চাহিদা হ্রাস পাইলে, ব্যবসায়ীদের মধ্যে কর ফাঁকি দিবার প্রবণতা বৃদ্ধিও অস্বাভাবিক নহে। ইহার ফলে যে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য এহেন শুল্ক-কর বৃদ্ধি, তাহাই বরং কমিয়া যাইতে পারে। অর্থাৎ আলোচ্য সিদ্ধান্তটি ব্যাকফায়ার করিলে বিস্ময়ের কিছু থাকিবে না। সরকার স্বীকার না করিলেও সচেতন মহলের বুঝিতে অসুবিধা হয় নাই, মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের বাড়তি ঋণের শর্ত মান্য করিতে যাইয়াই সরকার জনগণের উপর আরও করের বোঝা চাপাইয়াছে। বাস্তবে শুল্ক-করের পরিমাণ না বাড়াইয়া এইগুলির আওতা বা পরিসর বাড়াইয়া এই লক্ষ্য সহজেই পূরণ করা যাইত। বিভিন্ন খাতে কয়েক লক্ষ ব্যবসায়ী আছেন, যাহারা ভ্যাট দিতেছেন না। করহার কমাইয়া এই সকল ব্যবসায়ীকে ভ্যাটের আওতায় আনা হইলে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাইত। এমনও অভিযোগ রহিয়াছে, ভোক্তার নিকট হইতে আদায়কৃত শুল্ক-করের বড় অংশই ব্যবসায়ী ও এনবিআরের কর্মকর্তারা পরস্পরের যোগসাজশে লুট করিতেছেন, তাহা জমা হয় না সরকারের কোষাগারে। রাজস্ব আয় বাড়াইবার জন্য এনবিআর এহেন কর ফাঁকি ও চুরি বন্ধে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করিতে পারিত। অথচ এই সকল পদক্ষেপের কথা না ভাবিয়া এনবিআর যাহারা নিয়মিত ভ্যাট দিতেছেন, তাহাদের উপরেই আরও বোঝা চাপাইল। সরকারও এনবিআরের এই গতানুগতিক ব্যবস্থায় অনুমোদন দিল।
দুঃখজনক হইল, এই সিদ্ধান্ত এমন এক সরকার লইল, যাহারা জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের ফসল। উপরন্তু, এই সরকার যদ্রূপ মূল্যস্ফীতি হ্রাসের পাশাপাশি দেশের কর ব্যবস্থায় আমূল সংস্কারের মাধ্যমে ব্যবসায় ও ভোক্তা-বান্ধব কর ব্যবস্থা চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল, তদ্রূপ জনগণও সেই প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থা রাখিয়া অচিরেই জীবনযাত্রার ব্যয় হ্রাস পাইবে বলিয়া অপেক্ষা করিতেছিল। আলোচ্য সিদ্ধান্ত সেই আশার গুড়ে বালি ছিটাইয়া দিয়াছে বলিলে হয়তো ভুল হইবে না। সরকার অনতিবিলম্বে শুল্ক-কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা এবং টিসিবির মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সংকটগ্রস্ত মানুষের মধ্যে স্বল্পমূল্যে বিতরণ করিবে, এই আমাদের প্রত্যাশা।