আসসালামু আলাইকুম। আশা করি সবাই ভালো আছেন। আমিও ভালো আছি।
সকলকে রমাদান মুবারক। রমজান মাস মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র একটি সময়। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেনঃ
“হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারীতা (তাকওয়া) অর্জন করতে পার’’। (সূরা বাকারাঃ ১৮৩)
এই মাসে আমরা রোজা রেখে আত্মশুদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু অনেক সময় না বুঝেই এমন কিছু কাজ করে ফেলি, যা রোজা ভেঙে দিতে পারে। তাই সচেতন থাকার জন্য সকলের জানা জরুরি যে, কোন কোন কারণে আপনার অজান্তেই রোজা ভেঙে যেতে পারে। তো চলুন কুরআন-হাদিস ও বিভিন্ন রেফারেন্স এর আলোকে বিস্তারিত জেনে নিই।
ভুলবশত পানাহার করা, এরপরেও খেতে থাকা।
আমরা অনেকেই আছি যারা রোজা রেখে তা ভুলে যাই আর ভুলবশত কিছু না কিছু খেয়ে ফেলি। কিন্তু পরে যখন মনে পড়ে, তখন মনে করি যে রোজা ভেঙে গেছে। তাই আরও খেতে থাকি। কিন্তু এটা পুরোপুরি ভুল।
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেনঃ “যে ব্যক্তি ভুলে আহার করল বা পান করল, সে যেন তার রােজা পূর্ণ করে। কারণ আল্লাহই তাকে পানাহার করিয়েছেন।” (বুখারিঃ ১৯৩৩, মুসলিমঃ ১১৫৫)
অতএব আমরা বুঝতে পারলাম যে, ভুলে খেলে রোজা ভাঙে না। তবে ভুল বুঝতে পারার পরও ইচ্ছাকৃতভাবে খাওয়া চালিয়ে গেলে রোজা ভেঙে যাবে।
মুখে পানি বা অন্য কিছু প্রবেশ করা
ওজু বা গোসলের সময় অনেকেই নাকে বেশি পরিমাণে পানি টেনে নেন। এটা অসতর্কতাবশত গলার ভেতরে চলে যেতে পারে। এ ধরনের অসতর্কতা থেকে সাবধান থাকতে হবে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ “ওজু করার সময় নাকে পানি টেনে নাও। তবে তুমি রোজা রাখলে এতে বাড়াবাড়ি কোরো না।” (আবু দাউদঃ ২৩৬৬, তিরমিজিঃ ৭৮৮)
বমি হলে গিলে ফেলা
রোজা রেখেও অনেক সময় হঠাৎ বমি চলে আসে। যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। তবে কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করে বা বমি গিলে ফেলে, তাহলে তার রোজা নষ্ট হবে।
রাসুল (সা.) বলেছেনঃ “যদি কারও অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি হয় তবে তার রোজা ভাঙবে না। কিন্তু কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করে, তবে তার রোজা ভেঙে যাবে।” (তিরমিজিঃ ৭২০, আবু দাউদঃ ২৩৮০)

দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা খাবার গিলে ফেলা
অনেক সময় আমাদের দাঁতের ফাঁকে খাবারের কণা আটকে থাকে। কেউ যদি এটা অনিচ্ছাকৃতভাবে গিলে ফেলে, তাহলে রোজা ভাঙবে না। তবে নিজ ইচ্ছায় বা সচেতন থেকেও গিলে ফেললে রোজা ভেঙে যাবে।
(ফিকহ গ্রন্থঃ আল-মুগনি, ৩/১২৬)
ধোঁয়া, ধুলো বা সুগন্ধি গিলে ফেলা
ধোঁয়া বা সুগন্ধি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে গ্রহণ করা হয় আর তা গলার ভেতরে চলে যায়, তাহলে রোজা ভেঙে যেতে পারে। তাই পারফিউম বা আতর স্প্রে করার সময় সতর্ক থাকতে হবে। সুগন্ধি বা আতর স্প্রে করা যেহেতু এটি শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে গলায় প্রবাহিত হয় না তাই সাধারণত এটি রোজা ভাঙার কারণ হিসেবে গণ্য করা হয় না। তবে, যদি খুব কাছ থেকে বা মুখের কাছে স্প্রে করা হয়। আর তা শ্বাসের মাধ্যমে গলায় চলে যায়, তাহলে এটা রোজা ভাঙতে পারে। তাই রোজা অবস্থায় বাইরে বের হলে মাস্ক পড়ে বের হওয়াই উত্তম।
ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ “রোজার সময় খাবার, পানীয় বা যৌন সম্পর্ক ছাড়াও, শরীরের মধ্যে কোনো কিছু প্রবাহিত হলে রোজা ভেঙে যাবে।” (বুখারিঃ ২/৬৬৯)
ওষুধ বা ইনহেলার গ্রহণ করা
ইনহেলার ব্যবহারের ফলে রোজা ভেঙে যায় কি-না, তা নিয়ে ইসলামি ফকিহদের মধ্যে ভিন্ন মত রয়েছে। তবে আধুনিক গবেষণা ও ইসলামী ফিকহ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ইনহেলার রোজা ভাঙে না।
ইসলামী ফিকহ একাডেমি এবং সৌদি আরবের স্থায়ী ফতোয়া বোর্ডের মতেঃ ইনহেলার ব্যবহার করলে রোজা ভাঙে না। কারণ ইনহেলার থেকে নির্গত ওষুধের কণা পাকস্থলিতে পৌঁছানোর চেয়ে মূলত শ্বাসনালিতে প্রবেশ করে। এটা খাদ্য বা পানীয়ের বিকল্প নয়।
ইসলামিক ফিকহ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এটি সঠিকভাবে খাবার বা পানীয়ের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। (মাজমু’ ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দাইমাহঃ ১০/২৫৩)
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অসুস্থ অথবা সফরে থাকে, তাহলে সে অন্য দিনসমূহে সে সংখ্যা পূরণ করবে।” (সুরা বাকারাঃ ১৮৪)
কিছু ফকিহের মতে, ইনহেলার রোজা ভাঙতে পারে যদি এর উপাদান পাকস্থলিতে পৌঁছে যায়। কারণ, রাসুল (সা.) বলেছেনঃ “নাক দিয়ে ভালোভাবে পানি টেনে নাও, তবে রোজা অবস্থায় বাড়াবাড়ি কোরো না।” (আবু দাউদ: ১৪২, তিরমিজি: ৭৮৮)
তবে আধুনিক ফিকহ কাউন্সিলের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ইনহেলারের মূল কাজ শ্বাসনালীতে প্রভাব ফেলা, পাকস্থলিতে নয়। তাই এটি অধিকাংশ আলেমের মতে রোজা ভাঙে না। যাদের হাঁপানির সমস্যা আছে, তারা রোজা অবস্থায় ইনহেলার ব্যবহার করতে পারবেন। এতে তাদের রোজা ভাঙবে না। তবে আপনার যদি সন্দেহ থাকে, তাহলে সাহরির আগে ও ইফতারের পর ইনহেলার ব্যবহার করাই উত্তম হবে আপনার জন্য।
ইনজেকশন বা স্যালাইন নেওয়া
যেসব ইনজেকশন বা স্যালাইন শরীরে পুষ্টি বা ইম্যুনিটি দিয়ে থাকে, তা রোজা ভেঙে দিতে পারে। যেমনঃ গ্লুকোজ, স্যালাইন, নিউট্রিশন ইনফিউশন। তবে মাংসে (IM – Intramuscular), শিরায় (IV – Intravenous) বা চামড়ার নিচে (SC – Subcutaneous) যেসকল ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়, কিন্তু পুষ্টিকর নয়, তা রোজা ভাঙবে না। এছাড়াও ব্যথানাশক বা সাধারণ ওষুধের ইনজেকশন (যেমনঃ পেনিসিলিন, ইনসুলিন, অ্যান্টিবায়োটিক) রোজার ক্ষতি করে না।
(ফতোয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমঃ ১০/২৫২)
শাইখ ইবনে উথাইমিন (রহ.) বলেন “যেসব ইনজেকশন খাবার বা পানীয়ের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তা রোজা ভেঙে দেবে। তবে সাধারণ ওষুধের ইনজেকশন রোজা নষ্ট করবে না।” (ফাতাওয়া ইবনে উথাইমিন, ১৯/২০১)
চুইংগাম চিবানো
অনেকে মনে করেন যে, চুইংগাম চিবানো রোজার ক্ষতি করে না। কিন্তু চুইংগামের উপাদান ও স্বাদ মুখে প্রবেশ করার ফলে এটা রোজা ভেঙে দিতে পারে। তাই রোজা রেখে চুইংগাম চিবানো থেকে বিরত থাকা উচিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু খায় বা পান করে, তার রোজা ভেঙে যাবে।” (সহিহ বুখারিঃ ১৯৩৩ , সহিহ মুসলিমঃ ১১৫৫)
ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ “রোজা তখনই নষ্ট হয়, যখন কোনো বস্তু গলার ভেতরে চলে যায়।” (দারাকুতনি, 2/185)
চুইংগাম চিবানোর ফলে মুখের লালার সাথে মিশে যদি কোনো অংশ গলায় চলে যায়, তাহলে রোজা নষ্ট হয়ে যাবে।
রক্ত নেওয়া বা দেওয়া
রক্ত দিলে রোজা ভাঙবে না। তবে এটা শরীরকে দুর্বল করতে পারে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেনঃ “রক্তমোক্ষণকারী (হিজাম এবং যার রক্তমোক্ষণ করানো হয়েছে, উভয়ের সাওম (রোজা) নষ্ট হয়েছে।”(আবু দাউদঃ ২৩৬৭; ইবনে মাজাহঃ ১৬৭৯) শাইবান (রহ.) বলেন, আবূ কিলাবাহ বলেছেন, আবূ আসমা আর-রাহবী তাকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর আযাদকৃত গোলাম সাওবান (রাযি.) তা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছেন।
এই হাদিসের মূল প্রসঙ্গ ছিল “হিজামা” বা শিঙ্গা লাগানোর মাধ্যমে শরীর থেকে রক্ত বের করা। প্রাচীনকালে এটি একটি চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল। এর মাধ্যমে বিশেষভাবে কাটা স্থানে চোষণ (suction) করে রক্ত বের করা হতো।
তবে অন্য এক হাদিসে পাওয়া যায়, ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ “নবী (সা.) রোজা রেখেই হিজামা (শিঙ্গা লাগানো) করিয়েছেন।” (সহিহ বুখারিঃ ১৯৩৯)
হিজামার মাধ্যমে রক্ত বের করা আর রক্ত দান করা প্রায় একই রকম। অধিকাংশ ফকিহ রা বলেন, শুধুমাত্র রক্ত বের হলে রোজা ভাঙবে না।
যদি রক্তদানের ফলে এতটাই দুর্বলতা আসে যে স্যালাইন বা শক্তি বাড়ানোর কিছু গ্রহণের প্রয়োজন হয়, তাহলে স্যালাইনের কারণে রোজা ভেঙে যাবে। তবে শরীরে রক্ত নেয়া (যেমনঃ ব্লাড ট্রান্সফিউশন) পুষ্টিকর উপাদান বহন করে। তাই এটি রোজা ভেঙে দিতে পারে। শরীরে সরাসরি রক্ত প্রবেশ করা খাবারের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। অনেক ইসলামী স্কলার এটিকে রোজা ভঙ্গকারী হিসাবে গণ্য করে থাকেন।
সহবাস বা ইচ্ছাকৃত বীর্যপাত
রোজার সময় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক স্থাপন করা সম্পূর্ণ হারাম। যদি কেউ এটি করে, তবে তাকে কাফফারা আদায় করতে হবে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: “যদি কেউ রোজা থাকা অবস্থায় স্বামী-স্ত্রী সহবাস করে, তাহলে তার জন্য কাফফারা আদায় করা আবশ্যক।” (বুখারি: ১৯৩৬, মুসলিম: ১১১১)
আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ “এক ব্যক্তি নবী (সাঃ) এর কাছে এসে বলল, ‘আমি রমজানে দিনে আমার স্ত্রী সহবাস করে ফেলেছি।’ তখন নবী (সাঃ) তাকে কাফফারা আদায়ের নির্দেশ দেনঃ একটি গোলাম মুক্ত করা, তা সম্ভব না হলে দুই মাস ধারাবাহিক রোজা রাখা, তাও সম্ভব না হলে ষাটজন গরিবকে খাবার খাওয়ানো।” (সহিহ বুখারিঃ ১৯৩৬, সহিহ মুসলিমঃ ১১১১)
আল্লাহ বলেনঃ “রোজার রাতে তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস করা তোমাদের জন্য হালাল করা হলো।” (সূরা আল-বাকারা: ১৮৭)
রোজার সময় ইচ্ছাকৃতভাবে বীর্যপাত করলে (হস্তমৈথুন, স্পর্শ করা বা অন্য কোনো উপায়ে) রোজা ভেঙে যাবে, তবে কাফফারা দিতে হবে না। শুধু রোজার কাজা করতে হবে।
তবে অনিচ্ছাকৃত স্বপ্নদোষ বা বীর্য নিঃসরণ হলে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। ইবনে কুদামা (রহ.) বলেনঃ “যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে হস্তমৈথুন বা অন্য কোনো উপায়ে বীর্যপাত ঘটায়, তবে তার রোজা ভেঙে যাবে। কিন্তু কাফফারা আবশ্যক নয়। শুধু কাজা করতে হবে।” (আল-মুগনিঃ ৩/১২৮)
তো আজ এই পর্যন্তই।
আমার অন্যান্য পোস্ট দেখে আসতে পারেনঃ
সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ।