সংস্কারের ‘শর্টলিস্ট’ করুন

সংস্কারের ‘শর্টলিস্ট’ করুন

মতামত

হাসান মামুন

2025-01-18

সংবিধান সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে এর মূলনীতি পরিবর্তনে যে সুপারিশ করা হয়েছে, তাতে গণতন্ত্র প্রত্যাশিতভাবেই অটুট। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অঙ্গীকারগুলো ফিরিয়ে আনার কথাও বলা হয়েছে। এর সঙ্গে রাখা হয়েছে বহুত্ববাদকে। ধর্মের পাশাপাশি জাতি, ভাষা ও লিঙ্গগত বৈষম্যবিরোধী অঙ্গীকার জোরদার করতেই এটি করা হয়েছে। অবশ্য গণতন্ত্র মানেই বহুত্ববাদ। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার ছাড়া গণতন্ত্র কোথাও সফল হয়নি; হবেও না। ‘গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষাই আসলে প্রকাশ পেয়েছে উল্লিখিত সুপারিশে। 

গণতন্ত্রই ছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান অঙ্গীকার। সত্তরের নির্বাচনের রায় বাস্তবায়নে পাকিস্তানি শাসকচক্রের অনীহা এবং সেটি বানচাল করতে তাদের পরিচালিত গণহত্যাই আমাদের ঠেলে দেয় মুক্তিযুদ্ধে। এর পেছনে আবার ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোয় এ অঞ্চলের মানুষকে বঞ্চিত করে রাখার ইতিহাস। তাদের ন্যায্য দাবিকে করা হচ্ছিল পদদলিত। সেখান থেকে বেরিয়ে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রতিজ্ঞাই আমরা করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধে। এতে অংশগ্রহণকারী কোনো দল এ প্রশ্নে দ্বিমত জানায়নি। এ-ও সত্য, স্বাধীনতা-
উত্তরকালে গণতন্ত্রের দিকে যাত্রাটাই হয় বিঘ্নিত। এমন মত রয়েছে, বাহাত্তরে গৃহীত সংবিধানেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার যথেষ্ট সুযোগ রাখা হয়নি।  

পরে এতে যেসব সংশোধনী আনা হয়, তাতেও জনমতের বদলে দল ও গোষ্ঠীবিশেষের ইচ্ছাই হয়েছে প্রতিফলিত। ব্যতিক্রম হিসেবে যা করা হয়েছিল, সেটিকেও পরে করা হয় বিপরীতমুখী। এতে গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত নির্বাচন ব্যবস্থাটিই বিনষ্ট করে ফেলা হয়। বিগত সরকারের শাসনামলে স্থানীয় সরকার ও পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনেও ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছার বাস্তবায়ন পরিলক্ষিত। এ পথেই কায়েম হয় কর্তৃত্ববাদ– যেটি বর্ণিত হচ্ছে ‘মাফিয়াতন্ত্র’ কিংবা ‘ফ্যাসিবাদ’ বলে। নাম নিয়ে বিতর্ক থাকলে এর সরল অর্থ হলো গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি। এ অবস্থায় অপশাসন হয় ক্রমে জোরদার এবং রাষ্ট্রের সর্বস্তরে দুর্নীতি হয়ে ওঠে বাধাহীন, নজিরবিহীন। এটি ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’রও সম্পূর্ণ বিপরীত।  

দেরিতে হলেও কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটেছে নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থানে। এতে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার একটি বড় সুযোগ আমরা পেয়েছি। নব্বইয়ে সামরিক একনায়কতন্ত্রের অবসানের পর এমন আরেকটি সুযোগ অবশ্য মিলেছিল, যা আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। ‘ওয়ান ইলেভেন’ও শেষতক গণতন্ত্র জোরদারের বদলে নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস আর অপশাসনের পথ অবারিত করে দেয়। এ বিপুল ক্ষয়ক্ষতির পর চব্বিশে বদলে যাওয়া বাস্তবতা সংস্কার, নির্বাচন ও গণতন্ত্র জোরদারে আমাদের মনোযোগী করবে, এটিই প্রত্যাশা। গণতান্ত্রিক বিশ্বও একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ দেখতে চাইছে। তারাও সংস্কার ও অর্থবহ নির্বাচনের মাধ্যমে সুশাসনের পথে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা দেখতে বরাবর আগ্রহী। সমস্ত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন এক বড় অর্জন বৈকি। গণতন্ত্রের পথে যাত্রায় আমরা সফল হলে সেটিও কম গৌরবের হবে না। এতে দেশ থাকবে স্থিতিশীল ও নিরাপদ; অন্তর্ভুক্তিমূলক আর টেকসই উন্নয়নের পথেও আমরা এগোতে পারব।  

এ লক্ষ্য অর্জনে সামনে অনেক কাজ, সন্দেহ নেই। সব কাজ একসঙ্গে আর দ্রুততার সঙ্গে করাও সম্ভব নয়। পরিবেশ-পরিস্থিতি বিচারপূর্বক ‘অগ্রাধিকার’ স্থির করেও এগোতে হবে, যাতে মূল সংস্কারে ব্যর্থ না হই। সেটি আমাদের লক্ষ্যচ্যুতও করে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে আধুনিক বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সংঘটিত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলোও বিবেচনায় রাখতে হবে।
দেশের বিশেষ পরিস্থিতিও গভীরভাবে বিবেচ্য। গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে সুদীর্ঘ সময়ের জন্য নয়। তার কাজ ‘জরুরি সংস্কার’ সম্পন্ন করে একটি মানসম্মত নির্বাচনের ব্যবস্থা করা, যা আন্তর্জাতিকভাবেও হবে গৃহীত। জরুরি সংস্কার মানে যে সংস্কার এ মুহূর্তে না করলেই নয়। এতে সবার আগে আছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রশ্ন।
বিদ্যমান বিধিবিধান ও সামর্থ্যে কতটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব, সে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য অনেকে ‘আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন’ করতেও বলছেন। সামগ্রিক অবস্থা বিচারে তা হয়তো সম্ভব নয়। তবে বিগত জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতার নিরিখে যেসব সংস্কার জরুরি, সেগুলো চিহ্নিত করা কঠিন নয়। এ লক্ষ্যে গঠিত সংস্কার কমিশনও একই দিনে সরকারের কাছে সুপারিশমালা জমা দিয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন শুধু নয়; বরং একে অর্থবহ করে তুলতে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা আরও বাড়ানোর পাশাপাশি তার জবাবদিহি নিশ্চিতের সুপারিশও এতে রয়েছে। রাজনৈতিক দলে প্রত্যাশিত সংস্কার আনার লক্ষ্যে দেওয়া তাদের সুপারিশও সবার নজর কাড়বে।  

ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সম্মিলিত জাগরণে চব্বিশে সংঘটিত পরিবর্তন যে প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছে, তার প্রতিফলন সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশে থাকবে–এটিই স্বাভাবিক। একাত্তর ও নব্বইয়ের অপূরিত আকাঙ্ক্ষাও এতে ঘুরেফিরে প্রতিফলিত হবে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান তাদের রিপোর্ট পেশের দিন সে কথাটি বিশেষভাবে বলেছেন। সরকার এরই মধ্যে একটি ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ও করেছে, প্রধান উপদেষ্টা যার নেতৃত্বে। গণঅভ্যুত্থানের পর তাঁকেই সবাই বেছে নিয়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান পদে সেরা পছন্দ হিসেবে। সরকারের কাজ ঘিরে নানা 
সমালোচনার মধ্যেও তাঁর ওপর আস্থা এখনও অটুট। সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ নিয়ে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় রাজনৈতিক সংলাপে তাঁর ভূমিকা যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে, তা সহজে অনুমেয়। তবে তিনি বলেছেন, ‘রাজনৈতিক ঐকমত্য’ ছাড়া কোনো সংস্কারেই হাত দেবে না সরকার। এমন ঘোষণা ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা শঙ্কায় থাকা মানুষকে আশ্বস্ত করেছে। সংস্কার ও নির্বাচনের এক ধরনের রোডম্যাপও তিনি ঘোষণা করেছেন, যাতে চাইলেও কেউ এর বাইরে কিছু ভাবতে না পারেন। 

 এ অবস্থায় প্রত্যাশা, জরুরি সংস্কারের একটি ‘শর্টলিস্ট’ (সংক্ষিপ্ত তালিকা) তৈরি হবে এবং সব অংশীজনের সম্মতিতে দৃঢ়তার সঙ্গে তা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাবে সরকার। আলোচনা হবে সংস্কারের সব সুপারিশ নিয়েই। তবে জরুরি সংস্কারের তালিকা ধরে আলোচনা সম্পন্ন করতে হবে দ্রুত। প্রয়োজনে এর বাস্তবায়ন চলাকালে অন্যান্য সুপারিশ নিয়ে চলবে আলোচনা। সামনে রাষ্ট্র সংস্কারের নানা বিষয়ে আকর্ষণীয় সংলাপ দেখার অপেক্ষায় আমরা থাকব। তার উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখতেও সরকার সক্রিয় থাকবে বলে আশা। আইনশৃঙ্খলা ও পণ্যবাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে আনতে হবে। গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে বাড়াতে হবে সহিষ্ণুতা। সরকারকেও এ ক্ষেত্রে রাখতে হবে ইতিবাচক ভূমিকা। তার দিক থেকে কোনো সংস্কার বা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার ভুল ধারণাও যেন সৃষ্টি না হয়। সামনে সময় বেশি নেই। প্রতিটি দিন তাই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত জরুরি সংস্কার নিয়ে সংলাপের সময়সীমাও এ অবস্থায় বেঁধে দেওয়া যেতে পারে, যাতে না ওঠে কালক্ষেপণের অভিযোগ। অন্যান্য সংস্কারের ব্যাপারেও ‘যৌথ ঘোষণা’ আসতে হবে– যত দ্রুত সম্ভব। এর মধ্যে নির্বাচনের দিনক্ষণ বিষয়ে ধারণা পাওয়া গেলে রাজনৈতিক দলগুলোকে তার প্রস্তুতিও তো নিতে হবে। 

মানসম্মত নির্বাচনের মাধ্যমেই আমাদের এগোতে হবে। নির্বাচিত সরকারকেও সংস্কার কার্যক্রম রাখতে হবে অব্যাহত। রাজনৈতিক দলগুলোকেও জাতির প্রত্যাশা পূরণে স্বচ্ছতার অনুশীলনে যেতে হবে। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ অর্জনের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে কেউ টিকতে পারবে না– চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান থেকে এ শিক্ষাটিও নিতে হবে সবাইকে। 

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলামিস্ট

© Samakal
Shares:
Leave a Reply