
সাকরাইন উৎসবের জৌলুস কমেছে
রাজধানী
ইমরান হুসাইন 2025-01-14
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ‘সাকরাইন উৎসব’ আজ মঙ্গলবার। প্রতিবছর পৌষ মাসের শেষ দিন, অর্থাৎ পৌষসংক্রান্তিতে এ উৎসব উদযাপন করা হয়। এদিন রংবেরঙের ঘুড়িতে ছেয়ে যায় ঢাকার আকাশ। উৎসব ঘিরে কয়েক দিন আগে থেকেই অলিগলিতে বিরাজ করে আলাদা আমেজ। ধুম পড়ে যায় ঘুড়ি ও নাটাই কেনাবেচার। তবে এবারের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। দিনটি ঘিরে আগের মতো উদ্দীপনা নেই। কমেছে ঘুড়ি-নাটাই-সুতার বেচাকেনা।
গতকাল সোমবার পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, বংশাল, সূত্রাপুর, কোতোয়ালি, মুরগিটোলা, নারিন্দা ঘুরে সাকরাইন উৎসব উপলক্ষে তেমন আমেজ লক্ষ্য করা যায়নি। তবে দোকানে দোকানে আগের মতোই নানা রঙের, নানা আকারের ঘুড়ি, নাটাই, সুতা দেখা গেছে। এসব দোকানে ভিড় কম। অন্যান্যবার উৎসবের আগের দিন ছাদে ছাদে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রস্তুতি নিতে দেখা গেলেও এবার সে দৃশ্য খুব একটা চোখে পড়েনি।
বিক্রেতারা জানান, এবারও প্রজাপতি, চক্ষুদার, কাউটাদার, চশমাদার, পঙ্খিরাজ, পান, চ্যাপলা, বোয়াদার, ঈগল, লাভ ঘুড়ি, সাদা ঘুড়ি, দাবা ঘুড়ি, চারবোয়া, চিল, বাদুরসহ নানা নামের ঘুড়ি এসেছে। সঙ্গে বিক্রি হচ্ছে নাটাই ও সুতা। সাধারণ ঘুড়ি আকৃতিভেদে ৫ থেকে ২৫ টাকায় বিক্রি হয়। নকশা ও বিদেশি ঘুড়ির দাম ১০০ থেকে ৩৫০ টাকা। নাটাইয়ের দাম ১০০ থেকে ৮০০ টাকা।
শাঁখারীবাজারের ঘুড়ি ব্যবসায়ী লোকনাথ নাগ বলেন, জিনিসপত্রের দাম তুলনামূলক বেশি। ঘুড়ি বানাতে খরচ বেশি হচ্ছে। তাই দামও একটু বেশি। আমার কাছে ১০ থেকে ৪০০ টাকা দামের ঘুড়ি রয়েছে। নকশা করা ঘুড়ির দাম একটু বেশি। এ ছাড়া কম দামি, হালকা নকশার ঘুড়িও আছে। প্রতিবছর শুধু অর্ডার নিয়ে ১০ থেকে ১২ হাজার ঘুড়ি বিক্রি করি। এবার ৭০০ ঘুড়িও বিক্রি হয়নি।
ঘুড়ি কিনতে আসা লক্ষ্মীবাজারের বাসিন্দা তাহমিদ হাসান বলেন, ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য সুতা কিনতে এসেছিলাম। কিন্তু দাম বেশি। তার পরও কিছু করার নেই। ঐতিহ্যবাহী সাকরাইন উৎসবে ঘুড়ি ওড়াতেই হবে। সে জন্য বাধ্য হয়ে ৫০০ টাকা দিয়ে সুতা কিনলাম।
শাঁখারীবাজারের বাসিন্দা রমিজ্জ রাশা বলেন, সাকরাইন উৎসব উপলক্ষে বাসার ছাদে সাজানো হয় অস্থায়ী মঞ্চ। আনা হয় সাউন্ড সিস্টেম। ওড়ানো হয় ঘুড়ি। চলে ঘুড়ি কাটাকাটির প্রতিযোগিতাও। তবে এবার তেমন আয়োজন দেখা যাচ্ছে না। লোকজনের মধ্যে ঘুড়ি কেনার আগ্রহও কম।
আরেক বাসিন্দা বীরেন বোস বলেন, সাকরাইনে আগের মতো শিশু-কিশোররা ঘুড়ি ওড়ায় না। তারা এখন ডিজে গান বেশি বাজায়। আমাদের সময় হাজার হাজার ঘুড়ি ওড়ানো হতো। তখন মানুষ সাকরাইনটা সবচেয়ে বেশি উদযাপন করত।
সাকরাইনে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পুরান ঢাকার বাড়িগুলোর ছাদ থেকে ঘুড়ি ওড়ানো শুরু হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা রঙের ঘুড়িতে ছেয়ে যায় আকাশ। সন্ধ্যার পর শুরু হয় আতশবাজি, গানবাজনা ও আগুনের খেলা।
আদি ঢাকা সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি মানস বোস বাবুরাম বলেন, পুরান ঢাকায় আদিকাল থেকেই সাকরাইন উৎসব উদযাপিত হয়ে আসছে। তবে বর্তমান প্রজন্মের তরুণরা ঘুড়ি ওড়ানোর এ উৎসবকে ডিজে পার্টিতে রূপান্তর করেছে।
সাকরাইন উপলক্ষে গতকাল ঘুড়ি র্যালি হয়েছে। এবারের স্লোগান ছিল– ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা বাঁচান। ঐতিহ্যবাহী ঢাকাবাসী সংগঠনের আয়োজিত র্যালিতে নানা রঙের ঘুড়ি নিয়ে ঢাক বাজিয়ে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীরা অংশ নেয়। হাজারীবাগ পার্ক থেকে র্যালিটি বের হয়।
ঢাকাবাসী ও বাংলাদেশ ঘুড়ি ফেডারেশনের সভাপতি শুকুর সালেক সমকালকে বলেন, সাকরাইন মূলত পারিবারিক উৎসব। সবাই পরিবারের সঙ্গে পিঠাপুলি আর ঘুড়ি উড়িয়ে দিনটি উদযাপন করে। ডিজে পার্টি, উচ্চ স্বরে গান বাজানো আমাদের কালচার নয়। একে-অন্যের বাসায় দাওয়াত দেওয়া, এটাই আমাদের উৎসবের অনুষঙ্গ। বর্তমানে এসব কমেছে। সেই সঙ্গে কমেছে জৌলুস। সাকরাইন উৎসবে ভর করেছে ‘অপসংস্কৃতি’। এগুলো সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করতে হবে।