প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আইন থাকলেও বাস্তবায়ন নেই

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আইন থাকলেও বাস্তবায়ন নেই

বাংলাদেশ

 সমকাল প্রতিবেদক

2025-01-14

দেশে বেশির ভাগ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগে তারা সবচেয়ে বেশি প্রান্তিক অবস্থায় থাকেন। তাদের বেশির ভাগই ন্যূনতম স্যানিটেশন সুবিধা পান না। দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আইন, নীতিমালা ও কর্মপরিকল্পনা থাকলেও তার সঠিক বাস্তবায়ন নেই। ফলে তাদের অধিকার সুরক্ষায় এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে আইনের সঠিক বাস্তবায়ন প্রয়োজন। 

গতকাল সোমবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে দৈনিক সমকালের সভাকক্ষে ‘জলবায়ু পরিবর্তন ও ওয়াশ: প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাধান কেন গুরুত্বপূর্ণ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। সমকাল ও ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ যৌথভাবে এ সভার আয়োজন করে। 

সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের সিনিয়র ডিরেক্টর (অপারেশন্স) চন্দন জেড গমেজ, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেইঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাকিব হক, এডিডি ইন্টারন্যাশনালের এশিয়া রিজিওনাল ডিরেক্টর শফিকুল ইসলাম, আইসিডিডিআর,বির এনভায়রনমেন্ট হেলথ অ্যান্ড ওয়াশ রিসার্চ গ্রুপের অ্যাসোসিয়েট সায়েন্টিস্ট ড. নূহু আমিন, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক আবদুস সাত্তার, সেন্টার ফর ডিসঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্টের সহকারী পরিচালক আনিকা রহমান লিপি, দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক রাবেয়া বেবী, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের ন্যাশনাল কোঅর্ডিনেটর (ওয়াশ) পরিতোষ চন্দ্র সরকার এবং বি-স্ক্যানের সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের সহকারী অধ্যাপক ড. জেন উইলবার। সঞ্চালনা করেন সমকালের অনলাইন ইনচার্জ গৌতম মণ্ডল।

চন্দন জেড গমেজ বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের চলতে হবে। কিন্তু এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা। তাদের সুরক্ষার বিষয়ে আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই  শুরু হবে পরিবর্তনের।’ 

সাকিব হক বলেন, ‘দেশে অনেক ধরনের পলিসি রয়েছে; এসবের সঠিক বাস্তবায়ন জরুরি। এসব পলিসি প্রয়োজনে পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। ফাঁকফোকর থাকলে কাজ করতে হবে তা দূরীকরণে। এ ছাড়া জলবায়ু সহনশীলতা ও স্বাস্থ্য নিয়ে কোনো নীতিমালা এ দেশে নেই। এ নিয়েও কাজ করতে হবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় নিজেদের মতো করে কাজ করলেও তারা কোনো ধরনের শলাপরামর্শ করে না। সবাই নিজেদের ব্যানার ও লোগো প্রদর্শনে ব্যস্ত। দুর্যোগের সময় সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে একত্রে কাজ করতে হবে।’ 
জেন উইলবার বলেন, ‘দুর্যোগের সময় এবং পরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঠিক যত্ন প্রয়োজন। দুর্যোগকালে তাদের ক্ষতি থেকে রক্ষা করা ও ওয়াশ সেবা সবার জন্য সহজলভ্য করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। জলবায়ু সহনশীল ওয়াশ সেবায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাসহ তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে দৃশ্যমান প্রদক্ষেপ জরুরি।’

শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সারাদেশে কার্যকর, কম কার্যকর কিংবা অকার্যকর অনেক প্রতিবন্ধী সংগঠন রয়েছে। আমাদের উচিত তাদের সঙ্গে সংযোগ বাড়ানো। তাদের মাধ্যমে আমাদের তথ্য মানুষের মধ্যে সহজে পৌঁছানো সম্ভব।’ 

নূহু আমিন বলেন, ‘আমাদের মূল সমস্যা, হাতে তেমন তথ্য নেই। আবার তথ্য থাকলেও অনেক এনজিও তথ্যনির্ভর কাজ করে না। টাকা আছে কিন্তু তা তথ্যের ওপর নির্ভর করে অর্থায়ন করা হয় না। ফলে টাকাগুলো গতানুগতিকভাবে খরচ হচ্ছে।’ 

আবদুস সাত্তার বলেন, ‘দেশের ১৭০ মিলিয়ন মানুষ স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন সুবিধা পায় না। এমনকি হাসপাতালের ডাক্তার ও কর্মচারীরাও সচেতন না। তারা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয়তা বোঝেন না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাহিদা পূরণ করা গেলে ৫০ ভাগ জনসংখ্যার প্রয়োজনীয়তা সরাসরি পূরণ করা সম্ভব।’
আনিকা রহমান লিপি বলেন, ‘প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পে যে পরিমাণ অর্থায়ন হয়, তার কতটুকু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ব্যয় হয়, তার জবাবদিহি নিশ্চিত করা দরকার। এটা করা গেলে উন্নয়ন ও এনজিও সংস্থাগুলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিষয় নিয়ে কাজ করা শুরু করবে।’

রাবেয়া বেবি বলেন, ‘ঢাকার ভবনগুলোতে শুধু র‍্যাম্প আর অল্প কিছু সুবিধা থাকে। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী নারীরা মা হলে কিংবা ধর্ষণের শিকার হলে হাসপাতাল ও পুলিশের কাছে গিয়ে স্বাভাবিক ব্যবহারটুকুও পান না। একজন প্রতিবন্ধী নারী যে কাজ করে ক্ষমতায়িত হবেন, সে কাজের জায়গায় যেতেও তিনি নানা ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হন। তাঁর প্রজনন স্বাস্থ্য, পানি, স্যানিটেশনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’ 
পরিতোষ চন্দ্র সরকার বলেন, ‘বিভিন্ন দুর্যোগে স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বেশি ক্ষতির শিকার হন। পারিবারিক পর্যায়ে সরকার কিংবা অন্য কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে কোনো ধরনের পদক্ষেপও নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া প্রতিবন্ধিতার ধরনও ভিন্ন। একই কাঠামোর মধ্যে সব ধরনের প্রতিবন্ধিতার চাহিদা পূরণের বিষয়টি নিশ্চিত করাও কঠিন হয়ে পড়ে। সার্বিকভাবে এ বিষয়টি সামনে আনা জরুরি।’
সালমা মাহবুব বলেন, ‘নীতিমালা প্রণয়নকারীরা যদি গবেষণাগুলোর সুপারিশের ওপর মনোযোগ না দেন, তাহলে যত গবেষণাই করা হোক– তা কাজে আসবে না। তবে বিভিন্ন নীতিমালায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো কিছুটা হলেও বিভিন্ন বিষয় যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়নের জায়গায় আমরা যেতে পারিনি।’ 

সভাপতির বক্তব্যে আবু সাঈদ খান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের সময় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিশেষ সুযোগের দরকার হয়। সেই বিশেষ সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। ব্যক্তি, বেসরকারি এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আমাদের এই কাজটা করতে হবে। কেবল একটি এনজিও নয় বরং সব এনজিওকে এ বিষয়ে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সহায়তাও প্রয়োজন। তবে এনজিওগুলোও সব সময় কাজ করতে পারে না। কেননা, প্রকল্পগুলোর সঙ্গে অর্থায়নেরও একটা ব্যাপার আছে। এই জায়গায় সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করতে হবে।’

© Samakal
Shares:
Leave a Reply