
তিন শূন্য তত্ত্ব: বিশ্বায়ন, টেকসই উন্নয়ন ও মানবকল্যাণ
মতামত
মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ 2025-01-15
সম্প্রতি আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর ‘থ্রি জিরো’ বা তিন শূন্য তত্ত্বকে বৃহৎ পরিসরে তুলে ধরেন। ওই বক্তব্যে ড. ইউনূস আশাবাদ ব্যক্ত করেন, শূন্য তত্ত্ব এক নতুন সভ্যতার জন্ম দেবে। এতে গড়ে উঠবে সবার জন্য বাসযোগ্য এক নতুন পৃথিবী। তিন শূন্য অর্জনে তিনি চারটি মহাশক্তির কথা বলেছেন– তারুণ্য, প্রযুক্তি, সুশাসন ও সামাজিক ব্যবসা। তাঁর মতে, প্রত্যেক তরুণ হবে ‘থ্রি জিরো পারসন সিটিজেন’। অর্থাৎ তারা কার্বন নিঃসরণ করবে না; সম্পদ মজুতের পরিবর্তে সামাজিক ব্যবসা করবে এবং বেকারত্ব দূরীকরণে উদ্যোগী হবে।
বস্তুত বিশ্বায়ন, টেকসই উন্নয়ন ও তিন শূন্য তত্ত্বের ধারণা পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। এখানে বিশ্বায়ন হচ্ছে একটি সীমানাহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা, যার মূল লক্ষ্য বিশ্বব্যাপী অবাধ বাণিজ্য ব্যবস্থা জোরদার করা। কিন্তু বর্তমানে যে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া চলছে, তা প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করার ক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী। উন্নত রাষ্ট্রগুলো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর জেনেও বিভিন্ন লাভজনক প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্র হিসেবে দুর্বল বা অনুন্নত দেশগুলোকে প্রলুব্ধ করছে। জাতিসংঘ ২০১৫ সালে একটি বৈশ্বিক পরিকল্পনা সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কাছে পেশ করে। এসডিজি নামে পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে সব মানুষের জন্য টেকসই বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করা। এসডিজির মধ্যে আছে ১৭টি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ও ১৬৯টি লক্ষ্যমাত্রা। এ পরিকল্পনা হচ্ছে বিশ্বের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণ, ন্যায় ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা করে একটি নিরাপদ বিশ্ব গড়ে তোলার অঙ্গীকার। লক্ষণীয়, ২০১৫ সালেই তিন শূন্য তত্ত্ব প্রথম উপস্থাপিত হয় রাজধানী ঢাকার চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘সামাজিক ব্যবসা দিবস-২০১৫’ উদযাপনকালে এ তত্ত্ব দেন। অর্থাৎ শূন্য তত্ত্ব ও এসডিজি বিশ্ববাসীর কাছে কাছাকাছি সময়ে উপস্থাপিত হয়েছে। ‘শূন্য তত্ত্ব’ হচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রদত্ত ব্যক্তিগত মতবাদ। বিশ্ব সুরক্ষায় প্রদত্ত এ দার্শনিক মতবাদ এসডিজির সামগ্রিক লক্ষ্যের সমন্বিত রূপ। ড. ইউনূসের শূন্য তত্ত্বের ধারণা থেকেই বিশ্ববাসী এসডিজি বাস্তবায়নের অনুপ্রেরণা পাবে বলে আমি মনে করি।
১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ব্রিটেনের অর্থনীতি ও আর্থসামাজিক অবস্থায় মন্দা ভাব পরিলক্ষিত হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতির সার্বিক উত্তরণের লক্ষ্যে লেবার পার্টির পুনর্গঠনবিষয়ক মন্ত্রী আর্থার গ্রিনউড ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তমতে, ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম হেনরি বিভারিজের নেতৃত্বে ‘ইন্টারডিপার্টমেন্টাল কমিটি অন সোশ্যাল ইন্স্যুরেন্স অ্যান্ড অ্যালায়েড সার্ভিসেস’ শীর্ষক কমিটি গঠন করা হয়। বিভারিজ কমিশনের রিপোর্ট আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে আর্থনৈতিক সংস্কার সাধন ও সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আজও একটি আদর্শ মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত। বিভারেজ কমিশনের রিপোর্ট সমাজের অগ্রগতির পথে পাঁচটি অন্তরায় চিহ্নিত করেছিল। চিহ্নিত অন্তরায়গুলো হলো– অভাব, রোগব্যাধি, অজ্ঞতা, মলিনতা ও অলসতা, যা পঞ্চদৈত্য হিসেবে বিবেচিত। গত শতাব্দীর সমস্যা ও বর্তমান শতকের সংকটের ধরনে বহুলাংশে মিল রয়েছে। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয় বর্তমান শতকের বিরাজমান সব সমস্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। তাই তিন শূন্য তত্ত্বের লক্ষ্য অর্জনে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, যাতে আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য ভবিষ্যৎ রচনা করা সম্ভব হয়।
বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা স্বাধীনতার মহান অঙ্গীকার। একদিন তরুণ প্রজন্ম শপথ নিয়ে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল। স্বাধীন করেছিল বাংলাদেশ। উৎসর্গ করেছিল মূল্যবান জীবন। কিন্তু শহীদের বিসর্জন ও অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সরকার পরিচালনাকারীরা বারবার ব্যর্থ হয়েছেন। তারা স্বাধীনতার সুবিধাভোগী কিংবা হননকারী হিসেবে অতিমুনাফা, লুণ্ঠন, দুর্বৃত্তায়ন ও মুদ্রা পাচারে লিপ্ত। ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপের প্রাথমিক ফলমতে, বাংলাদেশের জনগণের আয়বৈষম্য পরিমাপক গিনি সহগের মান শূন্য দশমিক ৪৯৯ নির্ধারণ করা হয়েছে। এ হিসাবে অতিদ্রুত বাংলাদেশ একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ওয়েলথ এক্সের ‘ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ প্রতিবেদন-২০১৮’ মতে, এ দেশে অতি ধনীর সংখ্যা দ্রুতই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি তরুণ সমাজ বৈষম্যবিরোধী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে দেশে একটি গণবিপ্লবের সূচনা করেছে। আশা করা যায়, এ বিপ্লবের ফলে শূন্য তত্ত্বের বাস্তবায়ন গতিশীল হবে। দেশের দারিদ্র্য নিরসন ও কর্মসংস্থান সংকট দূর হবে। রাষ্ট্র সংস্কার ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন করা হোক সবার অঙ্গীকার।
মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ: অধ্যক্ষ, জাতীয় সমাজসেবা একাডেমি, আগারগাঁও, ঢাকা