
সময়ে এক ফোঁড় দিন
সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয় 2025-01-16
বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে জ্বালানি সম্পদ অনুসন্ধানে বিদেশি তৈল-গ্যাস কোম্পানি তথা আইওসিসমূহের অনাগ্রহ সম্পর্কে বুধবার সমকাল যেই সংবাদ দিয়াছে, উহা শুধু হতাশাজনক নহে; উদ্বেগজনকও বটে। প্রতিবেদনমতে, অনেক পথ পার হইয়া বঙ্গোপসাগরে তৈল-গ্যাস অনুসন্ধানের লক্ষ্যে গত মার্চে আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করিয়াছিল পেট্রোবাংলা। সাতটি বিদেশি আইওসি দরপত্রের নথি ক্রয়ও করিয়াছিল।
দরপত্র জমা প্রদানের সময়সীমা গত বৎসরের সেপ্টেম্বর হইতে বর্ধিত করিয়া ডিসেম্বর নির্ধারণ করিবার পরও কেহ কোনো প্রস্তাব জমা দেয় নাই। উপরন্তু, এই অনাগ্রহের কারণ জানিতে চাহিয়া সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলিকে প্রেরিত চিঠিরও উত্তর মিলে নাই। স্থলভাগে তৈল-গ্যাস প্রাপ্তির নূতন সম্ভাবনা কম থাকায় দেশের গ্যাস সংকট সমাধানের অন্যতম ভরসা হিসাবে দেখা হয় বঙ্গোপসাগরকে। দর প্রক্রিয়ায় কোনো বিদেশি কোম্পানির অংশগ্রহণ না করা তাই দেশের জ্বালানি খাতের জন্য দুঃসংবাদ। ইহার ফলে একদিকে বিদ্যমান গ্যাস ঘাটতি আরও বৃদ্ধি পাইবে, অন্যদিকে সেই ঘাটতি পূরণের জন্য ব্যয়বহুল এলএনজির উপর অধিকতর নির্ভরশীল হইতে হইবে।
আমরা জানি, বিশ্ববাজারে এলএনজির মূল্য হরহামেশাই উঠানামা করে। উপরন্তু, জাতীয়-আন্তর্জাতিক শক্তিশালী জ্বালানি ব্যবসায়ী লবির কারণে ইহার সরবরাহও বরাবরই গুটিকতক কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করে; গ্রাহকদের পকেট কাটিয়া স্বীয় পকেট ভর্তি করাই যাহাদের মূল বৈশিষ্ট্য। প্রসঙ্গত, দেশে দীর্ঘদিন যাবৎ গ্যাসের সংকট চলমান। বর্তমানে দেশে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা অন্তত ৪০০ কোটি ঘনফুট। ইহার বিপরীতে প্রতিদিন গড়ে ২৭৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। ইহার মধ্যে দেশীয় ক্ষেত্রগুলির গ্যাস গড়ে ১৯০ কোটি ঘনফুট। আমদানীকৃত এলএনজি হইতে মিলিতেছে ৮৫ কোটি ঘনফুট। ২০৩০ সালে গ্যাসের চাহিদা দাঁড়াইবে দৈনিক ৬৬৫ কোটি ঘনফুট। গত দুই বৎসরে প্রায় ৫০ কোটি ঘনফুট দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমিয়াছে। লক্ষণীয়, দৈনিক গ্যাস সরবরাহের মাত্র ২০-২৫ শতাংশ এলএনজি দিয়া মিটানো হয়। তাহাতেই অর্থনীতিতে ব্যাপক চাপ তৈয়ারি হইয়াছে। আগামীতে যদি চাহিদার ৪০-৫০ শতাংশ এলএনজি দিয়া মিটাইতে হয়, তাহা হইলে অর্থনীতিতে বিপর্যয় ঘটিবার আশঙ্কা রহিয়াছে।
এই সংবাদটি এমন সময়ে আসিল, যখন প্রধানত এলএনজির কারণে ব্যবসায় খাতে গ্যাসের মূল্য অত্যধিক বৃদ্ধি করা হইয়াছে। গৃহস্থালি কাজে ক্রমবর্ধমান হারে ব্যবহৃত এলপিজির মূল্যও বাড়ানো হইয়াছে। এমনকি পাইপলাইনে গৃহস্থালি কাজে সরবরাহকৃত সরকারি গ্যাসের মূল্যও বৃদ্ধি পাইতে চলিয়াছে। সকল ক্ষেত্রে গ্যাসের এহেন মূল্যবৃদ্ধি শুধু বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিকেই আরও ঊর্ধ্বমুখী করিবে না, বিনিয়োগে ভাটা সৃষ্টি করিয়া কর্মসংস্থানও সংকোচন ঘটাইবে। যাহার ফলস্বরূপ সামাজিক ও এমনকি রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হইলেও বিস্ময়ের কিছু থাকিবে না। সত্য, বিগত সরকার গত এক দশকও এই অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করিতে পারে নাই। যদিও প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারত একই সমুদ্র হইতে বহু পূর্বেই গ্যাস উত্তোলন করিতেছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, উক্ত সমুদ্রাঞ্চলে মিয়ানমার যদ্রূপ বিপুল গ্যাস পাইয়াছে তদ্রূপ সম্ভাবনা বাংলাদেশেরও রহিয়াছে। কিন্তু মুখ্যত এলএনজি লবির স্বার্থ চরিতার্থের জন্য বিগত সরকার বঙ্গোপসাগরে তৈল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিলম্ব করিয়াছে। তবে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ শুনিয়া বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যখন মডেল পিএসসিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনিয়া দরপত্র কার্যক্রমকে অপেক্ষাকৃত আকর্ষণীয় করিয়া তুলে তখন আমরা উহার সাফল্য সম্পর্কে আশাবাদী হইয়াছিলাম। কিন্তু বাস্তবতা সেই আশাবাদ ভঙ্গ করিল। এখন অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু না হইবার কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে সমুদ্র হইতে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা নাই।
বিশিষ্ট ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম যথার্থই বলিয়াছেন, কোনো প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা না দেওয়ায় সাগরে অনুসন্ধান কার্যক্রম পিছাইয়া গেলেও ইহার পশ্চাতে লাগিয়া থাকিতে হইবে। কারণ, দেশের জ্বালানি সংকট মিটাইতে এই গ্যাস খুবই দরকার। এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখিবার বিকল্পও নাই।