গোটা বাংলাদেশ মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে! কে দায়ী?
একটা সময় ছিল, যখন গ্রামের সকাল মানেই কুয়াশার চাদরে ঢাকা শীতল পরিবেশ, আর দুপুর হতো রোদের উষ্ণতায় মেখে থাকা কর্মময় দিন। কিন্তু আজ? এখন সকাল গড়াতে না গড়াতেই শরীর পুড়িয়ে দেয়া রোদ যেন চামড়ার ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। এমন একটা সময় আসবে, যখন (বাংলাদেশ মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে) এই বাক্যটা শুধু আতঙ্ক নয়, বাস্তবতাই হয়ে দাঁড়াবে, সেটা হয়তো আমরা কল্পনাও করিনি। কিন্তু আজ তা কল্পনার সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে চুয়াডাঙ্গা থেকে শুরু করে গোটা দেশজুড়ে এক নির্মম বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে।
দামুড়হুদা উপজেলার তরুণ কৃষক জাকির হোসেনের করুণ মৃত্যু আমাদের সামনে খুলে দিয়েছে সেই কঠোর সত্যের দরজা। ৩০ বছরের কম বয়সী এক যুবক, যিনি শুধু নিজের পরিবারের জন্য দুবেলা খাবার জোগাড় করতে গিয়ে সূর্যের তাপে হিট স্ট্রোকে প্রাণ হারালেন। একটা দেশ কতটা পুড়ে গেলে একজন কৃষক নিজের জমিতে নামাটাকেই নিজের শেষ যাত্রা বানিয়ে ফেলে? চুয়াডাঙ্গার গরম সমস্ত রেকর্ড ভেঙে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ছুঁয়েছে। দিনে মাঠে কাজ করা অসম্ভব, আর রাতে ঘুম ভেঙে যায় দমবন্ধ গরমে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন চুয়াডাঙ্গা বারবার দেশের গরম-শীতের চ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠছে? এর উত্তর লুকিয়ে আছে ভৌগোলিক বাস্তবতায়। চুয়াডাঙ্গার উপর দিয়ে গেছে কর্কটক্রান্তি রেখা, যার প্রভাবে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত সূর্য একদম মাথার উপরে থাকে। এই সময়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তর ও মধ্য প্রদেশ থেকে আসা লু হাওয়া এসে চুয়াডাঙ্গার আবহাওয়াকে করে তোলে আরও শুষ্ক, আরও দাহ্য। বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, এই বাতাস ও সরাসরি সূর্যের তাপ মিলিয়ে পারদ স্বাভাবিকের চেয়ে দুই ডিগ্রি বেশি ওঠে। ফলে সমতল ভূমির চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, দিনাজপুর বা নাটোর হয়ে ওঠে একপ্রকার তপ্ত চুলা।
তবে গরমের তাণ্ডব এবার শুধু উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলেই সীমাবদ্ধ নেই। স্যাটেলাইট ইমেজে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের মানচিত্রে যেখানে হাত রাখবেন, সেখানেই তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে। এমনকি, বিশ্বজুড়ে গরমের তালিকায় বাংলাদেশ এখন সৌদি আরব, ওমান, সুদান ও দক্ষিণ আফ্রিকাকেও পেছনে ফেলেছে। এই তথ্য কোনো অনুমান নয় সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল ইনফরমেশন (NCEI) এবং ইউরোপীয় ক্লাইমেট মনিটরিং গ্রুপ Copernicus-এর প্রকাশিত ডেটাতে এই তাপমাত্রার তুলনা স্পষ্টভাবে এসেছে।
এখন প্রশ্ন উঠছে এই ভয়ংকর গরম শুধু এক বছরের ব্যাপার, নাকি এটি একটি স্থায়ী জলবায়ু সংকটের পূর্বাভাস? এখানে আসলে আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক গভীর বিপদের মুখোমুখি, যা কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং আমাদের অর্থনীতিকেও প্রতিদিন একটু একটু করে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ শ্রমজীবী মানুষ। তারা কৃষিকাজ, নির্মাণ, পরিবহন, এই তিনটি খাতেই অধিকাংশ সময় খোলা আকাশের নিচে কাজ করে। এখন এই প্রচণ্ড গরমে তাদের শরীর অতি দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ছে, কাজের গতি কমে যাচ্ছে, কর্মঘণ্টা হ্রাস পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO)-র একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী দৈনিক কর্মঘণ্টার প্রায় ২% হারিয়ে যাবে শুধু অতিরিক্ত গরমের কারণে। ভাবুন তো, এটি বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন ৮ কোটি শ্রমিকের পূর্ণদিবস কাজের সমান!
এই ক্ষতির অনুপাতে বাংলাদেশের অবস্থান কতটা বিপজ্জনক, তা বোঝা যায় Adrienne Rockefeller Foundation এর এক গবেষণা রিপোর্ট থেকে। ২০২৩ সালে বারোটি শহরের উপর চালানো গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু ঢাকা শহরেই অতিরিক্ত গরমের কারণে প্রায় ৬০০ কোটি ডলারের শ্রমক্ষমতা হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিবছর। এই ক্ষতির পরিমাণ ঢাকার মোট বার্ষিক শ্রম উৎপাদনের ৮ শতাংশের সমান।
এদিকে শুধু শ্রমঘণ্টার ক্ষতিই নয়, প্রচণ্ড গরমে খাবার নষ্ট হওয়ার হারও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। কোল্ড চেইন অবকাঠামো দুর্বল থাকায় ফ্রেশ প্রোডাক্ট পরিবহনের সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রচুর খাদ্যদ্রব্য। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শুধু ফলমূল ও শাকসবজি পরিবহনের সময় গ্রীষ্মকালে গড়ে ২৫% পণ্য নষ্ট হয়। এই নষ্ট খাদ্যের আর্থিক মূল্য বছরে হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়, যেটা সরাসরি মূল্যস্ফীতি এবং খাদ্য নিরাপত্তার উপর প্রভাব ফেলছে।
গরম যে শুধু এক মৌসুমি ব্যথা নয়, বরং এক দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ব্যাধি এ কথা এখন বোঝা যাচ্ছে দিন দিন আরও স্পষ্টভাবে। আর এই ব্যাধির মূল কারণ হিসেবে উঠে আসছে একটি শব্দ জলবায়ু পরিবর্তন।
জাতিসংঘ ১৯৯৫ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে আয়োজন করছে ক্লাইমেট কনফারেন্স বা COP। COP27, COP28-এর মতো সম্মেলনে বারবার বলা হয়েছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে আটকে রাখা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রীনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ ৪৩% কমানো জরুরি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যেসব উন্নত দেশ সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করছেচীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত তারা নিজেরাই এই প্রতিশ্রুতি পূরণে অনাগ্রহী। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের মতো দেশেরাই, যারা নিজে খুব কম নিঃসরণ করেও সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে।
সাহায্য-সহযোগিতার কথা উঠলেও, বাস্তবে তা অনেকটাই প্রতীকী হয়ে থাকে। উন্নত দেশগুলো ১০০ বিলিয়ন ডলারের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার খুব সামান্য অংশই বাস্তবে এসেছে। বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত মাত্র ২০০ মিলিয়ন ডলার অ্যাডাপটেশন ফান্ড পেয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য।
এমনকি বাংলাদেশে গরমের প্রভাব শহুরে অবকাঠামোর মাধ্যমে আরও খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে। ইউরোপ-আমেরিকাকে অনুসরণ করে আমরা তৈরি করছি বিশাল বিশাল কাচের দালান। ভাবিনি এই কাচের প্রতিফলিত রোদ এক একটি হিটিং চেম্বারে রূপ নিচ্ছে! বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ভবনগুলোর ছাদ ও দেয়ালে প্রতিফলিত সূর্যরশ্মি আশপাশের তাপমাত্রা ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এর বিপরীতে উদাহরণ হতে পারে সিঙ্গাপুর। আমাদের মতোই উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুর দেশ হয়েও তারা অবকাঠামো নির্মাণে প্রাধান্য দিয়েছে ছায়া সৃষ্টি, সবুজায়ন ও বায়ুসঞ্চালনের মতো বৈশিষ্ট্যকে। ঢাকার মত একটি শহরে কেন আমরা এ ধরনের পরিকল্পনাকে গুরুত্ব দিতে পারছি না?
ঢাকার মত শহরে শুধু প্রতিফলিত তাপ নয়, একধরনের তাপ-আটকে রাখার (heat retention) প্রক্রিয়াও কাজ করে। কংক্রিট, পিচঢালা রাস্তা, কাচ, এবং গাছপালা ও খোলা জায়গার অভাব সব মিলিয়ে শহরের ভেতরে একপ্রকার (Urban Heat Island) তৈরি হয়েছে। এর ফলে শহরের তাপমাত্রা গ্রামাঞ্চলের তুলনায় ৩-৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হয়ে থাকে। আপনি যদি দিনভর গরমে অতিষ্ঠ হয়ে থাকেন, সেটা প্রকৃতি নয় মানুষ নির্মিত শহরেরই প্রতিফলন।
এখন যদি আমরা প্রশ্ন করি, কে দায়ী? তাহলে একটাই উত্তর উঠে আসে আমরাই। আমরা নিজেরাই একের পর এক গাছ কেটে কংক্রিটের দালান বানিয়েছি। খাল বিল-জলাশয় ভরাট করে তৈরি করেছি হাউজিং প্রজেক্ট। এমনকি ছাদবাগান করার সহজ উপায় থাকলেও, বেশিরভাগ দালানের ছাদ ফাঁকা পড়ে থাকে। চুয়াডাঙ্গা, যশোর, রাজশাহীতে গ্রীষ্মে এক ফোঁটা বৃষ্টি নেই, অথচ রাতারাতি গাছ কেটে বসানো হচ্ছে নতুন ভবনের পাইলিং।
বাংলাদেশে গত ২০ বছরে ৩৩% প্রাকৃতিক জলাভূমি হারিয়ে গেছে। বন বিভাগের তথ্য বলছে, ২০০০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের বনভূমির পরিমাণ ১৪% কমেছে। গাছ যত কমে, পৃথিবীর ঘাম মুছিয়ে দেওয়ার মতো ছায়াও ততই হারিয়ে যায়।
শুধু পরিবেশগত দিক নয়, স্বাস্থ্যখাতেও এই চরম গরম ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনছে। শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে ডিহাইড্রেশন, হিট স্ট্রোক, স্কিন ডিজিজ বেড়েছে কয়েকগুণ। গত এপ্রিলেই রাজশাহী মেডিকেল কলেজে তিনজন শিশু এবং দুইজন বয়স্ক ব্যক্তি হিট স্ট্রোকে মৃত্যুবরণ করেছেন। ঢাকার আইসিডিডিআরবি-তে রেকর্ড করা হয়েছে, এপ্রিল মাসে ডায়রিয়া ও তাপ-জনিত রোগে আগের বছরের তুলনায় ৩৮% বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে।
আরেকটি ভয়ঙ্কর সংকট তৈরি হচ্ছে জল সংকট। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বহু এলাকায় পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে। অতিরিক্ত গরমে চাহিদা বাড়ছে, কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের হার তুলনামূলক অনেক বেশি হয়ে গেছে। ওয়াসার হিসেবে, ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসেই ঢাকায় দৈনিক পানির চাহিদা দাঁড়িয়েছে ২৬৫ কোটি লিটার, যা বছরখানেক আগের তুলনায় প্রায় ৯% বেশি। কিন্তু পানির সরবরাহ সে তুলনায় স্থিরই রয়ে গেছে।
এখন যদি কেউ ভাবে, (বৃষ্টি হলেই তো ঠান্ডা হয়ে যাবে) তাহলে ভুল করবেন। কারণ বিজ্ঞান বলছে, তাপমাত্রা যত বাড়ে, বাতাস তত বেশি জলীয়বাষ্প ধারণ করতে পারে। কিন্তু সেই জলীয়বাষ্প যদি বৃষ্টি হয়ে না পড়ে, তখনই তৈরি হয় এক ভয়ংকর আবহ humid heat। আপনি তখন গরমে ঘেমে যাচ্ছেন, কিন্তু বাতাস এতই স্যাচুরেটেড যে ঘাম শুকাচ্ছে না। ফলে শরীরের স্বাভাবিক কুলিং সিস্টেম নষ্ট হয়ে যায় আর তখনই হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।
বাংলাদেশের শিক্ষা ও কাজের পরিবেশেও এই গরম এক মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অন্তত ৬০% ক্লাসরুমে কোনো ফ্যান বা শীতলীকরণ ব্যবস্থা নেই। শিশুদের মনোযোগ কমে যাচ্ছে, অসুস্থতা বাড়ছে। ফ্যাক্টরিগুলোতে শ্রমিকদের অভিযোগ, ১২ ঘণ্টা কাজের মাঝে মাত্র ৫ মিনিট ঠাণ্ডা হাওয়ার সংস্পর্শ মিলছে। এমন অবস্থায় প্রোডাকটিভিটি শুধু পরিসংখ্যানেই থাকে, বাস্তবে তা ধ্বংসপ্রাপ্ত।
কিন্তু আশার কথা হচ্ছে, সমাধান অসম্ভব নয়। ভারতের আহমেদাবাদ শহর ২০১০ সালে এক ভয়াবহ তাপপ্রবাহে ১৩০০ জন মানুষ হারানোর পর একটি Heat Action Plan বাস্তবায়ন করে। তারা শহরের প্রতিটি এলাকায় তাপমাত্রা মাপার ইউনিট বসিয়েছে, নির্ধারিত তাপমাত্রার পর স্কুল-কলেজ বন্ধ, মাঠে কাজ সীমিত, ওষুধ ও পানির ব্যবস্থা সবই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্রিয় হয়ে যায়।
বাংলাদেশও যদি চায়, তবে প্রতিটি জেলা শহরে Urban Heat Management Unit গঠন করে বাস্তব সময়ের তাপমাত্রা মনিটরিং, গাছ রোপণ বাধ্যতামূলক, এবং কংক্রিটের ছাদে পরিবেশবান্ধব রঙ প্রয়োগ করে তাপ প্রতিফলন কমাতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিসে বিকল্প সময়সূচি নির্ধারণ করা জরুরি।
আরো জরুরি নীতিনির্ধারকদের সদিচ্ছা। আমরা যদি আজই এই বিপদের গুরুত্ব না বুঝি, তবে আগামী প্রজন্ম শীতকাল কেবল বইয়ের পাতায় পড়বে, মাঠে খেলতে গিয়ে হিট স্ট্রোকে প্রাণ দেবে, আর আমরা ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে লজ্জিত হবো।
আমরা যদি চাইলেই চাঁদের মাটি থেকে খনিজ তুলে আনতে পারি, তবে নিজ দেশের মাটিতে কিছু গাছ লাগাতে কেন পারবো না?
বাংলাদেশ মরুভূমি হয়ে যাবে কিনা, সেটা এখন আর প্রকৃতির হাতে নেই। সেটা এখন নির্ভর করছে আমাদের হাতে আমাদের কাজ, সচেতনতা, এবং সদিচ্ছার উপর।
Written & Researched by (Writesomnia)