একটু চোখ বন্ধ করে ভাবুন, আপনি নিজেকে দেখছেন স্টুডিও ঘিবলির কোনো এক জাদুকরী জগতের বাসিন্দা হিসেবে। গোল গোল বড় বড় চোখ, টকটকে লাল গাল, আর স্বপ্নময় এক চেহারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুললেই যেন আজ এই দৃশ্য চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। দোলনায় দোল খাওয়া থেকে শুরু করে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন, ঘিবলি ফিল্টার যেন সবার বাস্তবতাকে এনিমের কল্পনার জগতে টেনে নিয়ে গেছে।

এই ট্রেন্ডে কেউ বাদ পড়েননি। বলিউড তারকা থেকে শুরু করে আমাদের আশেপাশের পাড়ার মামা-ফুপু, টিউশনের স্যার-ম্যাডাম সবাই যেন নিজেদের ঘিবলি ভার্সনে রূপান্তরিত করে দুনিয়াকে দেখাচ্ছেন। কেউ কেউ তো আবার বলছেন, এখন যদি কারও ঘিবলি ফেস না থাকে, তাহলে বুঝতে হবে তার সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টই নেই! যেন এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে প্রবেশ করেছে সবাই।

কিন্তু এত আনন্দের মাঝেও একটা গুরুতর প্রশ্ন থেকেই যায়। আপনি কী নিশ্চিত, এই ঘিবলি আনন্দের আড়ালে নিজের জীবনের সাথে এক চরম খেলায় মেতে উঠছেন না?

শিল্পের সম্মান, নাকি কৃত্রিম কপি?

ঘিবলি ফিল্টারের ব্যবহারকারীরা যেটা খুব কমই চিন্তা করছেন, সেটা হলো এর পেছনে থাকা মূল শিল্পীর সম্মান আর অধিকার। স্টুডিও ঘিবলি নির্মাতা হায়াও মিয়াজাকি, যিনি বছরের পর বছর ধরে নিজ হাতে ঘাম ঝরিয়ে এই অনন্য স্টাইল সৃষ্টি করেছেন, তিনি আজ এই এআই কপিরাজির সামনে রীতিমতো ক্ষুব্ধ।
সূত্র অনুযায়ী, মিয়াজাকি একাধিকবার প্রকাশ্যে বলেছেন, (এআই যদি শিল্প সৃষ্টি করে, তবে তা শিল্পীর পরিশ্রম ও আত্মার প্রতি অপমান।) তাঁর স্টুডিও ও ইতিমধ্যে কিছু এআই টুলের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে। তাদের দাবি একেবারে স্পষ্ট কোনো অনুমতি ছাড়া শিল্পের নকল নির্মাণ চরমভাবে অগ্রহণযোগ্য।

এখানে একটা ভেবে দেখার মতো বিষয় হলো, আপনার যদি কোনো দিন কেউ এসে আপনার জীবনের সমস্ত সংগ্রাম, সমস্ত শ্রম এক নিমেষে কপি করে মজা করত, আপনি কি মেনে নিতে পারতেন? শিল্পের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটছে। মিয়াজাকির রঙে-তুলিতে গড়া স্বপ্নের দুনিয়া আজ বিনা অনুমতিতে মজা করার এক খেলনায় পরিণত হয়েছে।

ব্যক্তিগত তথ্যের লুকোচুরি

শুধু শিল্পের অপমানের দিক থেকে দেখলেও পুরো চিত্রটা ধরা পড়ে না। আরও ভয়ঙ্কর বিপদের দিক রয়েছে, যেটা অনেকেই অবহেলা করছেন সেটি হল নিজস্ব ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা।

ঘিবলি ফিল্টার ব্যবহার করতে গিয়ে যখন আপনি নিজের ছবি আপলোড করেন, সেটি শুধু আপনার একটি ঘিবলি স্টাইলে পরিবর্তন করছে না। বরং আপনার মূল ছবিটিও রয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট টুলের সার্ভারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আপনি যদি পরে সেই ছবি মুছেও দেন, সেটি তখনও সার্ভারের ডেটাবেসে থেকে যেতে পারে। ভবিষ্যতে সেই ছবি দিয়ে এআই নিজেকে আরও প্রশিক্ষিত করতে পারে, এমনকি আপনার অজান্তেই কোনো বিজ্ঞাপন বা অ্যাপ্লিকেশনে আপনার মুখের পরিবর্তিত রূপ ব্যবহার করতে পারে।

কল্পনা করুন একদিন হঠাৎ করেই আপনি দেখলেন, একটি স্মার্টফোন অ্যাপে আপনার ঘিবলি-রূপী ছবি ঘুরছে। অথচ আপনি কোনো অনুমতিই দেননি! সেই মুহূর্তে আপনার ভয়, হতাশা আর রাগ কেমন হবে, একটু চিন্তা করে দেখুন।

আইনগত ঝুঁকি ও সামাজিক দ্বন্দ্ব

এখানেই শেষ নয়। যদি আপনি মজা করে কোনো সেলিব্রিটির ছবি ঘিবলি ফিল্টারে ব্যবহার করেন, তাহলে বিষয়টি আরও জটিল হতে পারে।
আইন বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, অপরের ছবি বা ব্যক্তিগত পরিচয় ব্যবহার করে কোনো ডিজিটাল রূপ তৈরি করা কপিরাইট লঙ্ঘনের আওতায় পড়তে পারে। বিশেষ করে কোনো পাবলিক ফিগারের ছবি নিয়ে এরকম করলে আইনি নোটিশ বা ক্ষতিপূরণ দাবি পর্যন্ত আসতে পারে।

তার মানে, মজার ছলে করা একটি ছোট্ট কাজও আপনাকে বড়সড় আইনি সমস্যায় ফেলে দিতে পারে। আর এই ঝুঁকি এখন আর কল্পনার বিষয় নয়, বাস্তবে ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। সুতরাং খেয়াল রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ, নিজের ছবির পাশাপাশি অন্যের ছবিকেও এমন প্রযুক্তির হাতে তুলে দেবার আগে দশবার ভাবা উচিত।

প্রযুক্তি ও শিল্পের টানাপোড়েন

অনেকেই বলেন, প্রযুক্তির অগ্রগতিকে রোধ করা সম্ভব নয়। অতীতেও যখন ফটোশপ বা ডিজিটাল আর্ট টুলস বাজারে এসেছিল, তখনও শিল্পী সমাজের একাংশ আশঙ্কা করেছিল, শিল্পের মৃত্যু ঘটবে। কিন্তু সময়ের সাথে প্রমাণ হয়েছে, শিল্পের আসল মূল্য কখনও কৃত্রিমভাবে মুছে ফেলা যায় না।

তবে এখানে বড় প্রশ্নটা অন্যখানে। যখন কোনো প্রযুক্তি শিল্পীর মৌলিকতা কপি করে, অথচ শিল্পীকে স্বীকৃতি দেয় না, তখন সেটা কেবল প্রযুক্তির অগ্রগতি নয়, বরং শিল্পীর প্রতি সরাসরি অবমাননা।
ডিজিটাল অধিকার সংস্থাগুলোর মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি মানুষের পরিশ্রম আর সৃষ্টিকে সম্মান না করে, তবে ভবিষ্যতে এটি শিল্প এবং শিল্পীর মধ্যে এক গভীর বিভেদ তৈরি করবে। এমন বিভেদ যেটা সহজে পূরণ করা যাবে না।

সুতরাং শুধু মজা নয়, নিজেদের সৃষ্টিশীলতার, সম্মান এবং অধিকার বাঁচিয়ে রাখাটাও আমাদের দায়িত্ব। বিশেষ করে যখন প্রযুক্তি আর আনন্দের মাঝের সীমানা এতটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।

সেলফি আনন্দের আড়ালে ডেটা শিকার

আজকের দিনে আমরা হয়তো খুব সহজে একটা ছবি দিলাম, আর মজা পেলাম, এমনভাবে বিষয়টি দেখি। কিন্তু প্রযুক্তির বড় বড় সংস্থাগুলো ঠিক কীভাবে আমাদের তথ্য ব্যবহার করে সেটি গভীরভাবে ভাবার সময় এখন এসেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক এআই টুল বা ফিল্টার-ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন ছবি আপলোডের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর মেটাডেটা সংগ্রহ করে। এই মেটাডেটা শুধু আপনার মুখের কাঠামো নয়, আপনার ত্বকের রঙ, চোখের গঠন, এমনকি আবেগ প্রকাশের ভঙ্গিও বিশ্লেষণ করতে পারে। এই সব তথ্য ভবিষ্যতে ব্যবহার হতে পারে উন্নত ফেসিয়াল রিকগনিশন সিস্টেম তৈরিতে।

আপনি হয়তো ভাবছেন, এতে ক্ষতি কী? সমস্যা হলো, এই ধরনের তথ্য কখন, কোথায় এবং কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার হবে, তা আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ভবিষ্যতের কোনো অজানা পরিস্থিতিতে, আপনার নিজেরই দেয়া ছবি আপনার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে, তখন আর কিছু করার থাকবে না।

ভার্চুয়াল জগতের বাস্তব বিপদ

যখন আমরা ঘিবলি ফিল্টারের মতো ট্রেন্ডে মজা পাই, তখন হয়তো ভেবে দেখি না, এই ডিজিটাল কপি সংস্কৃতি আমাদের মানসিকতাতেও একটা পরিবর্তন আনছে।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘিবলি বা অন্য যেকোনো এআই ফিল্টার যখন মানুষকে আরও আকর্ষণীয়, ফ্যান্টাসি-ভিত্তিক রূপে দেখায়, তখন অনেকেই নিজের বাস্তব রূপ নিয়ে অসন্তুষ্ট বোধ করতে শুরু করে। এতে করে সেলফ ইমেজ ডিসঅর্ডার, আত্মসম্মানহানী, এমনকি বিষণ্ণতার ঝুঁকিও বেড়ে যায়।

বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীদের জন্য এই বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। সামাজিক মাধ্যমে প্রতিনিয়ত কৃত্রিম সৌন্দর্য্যের সাথে তুলনা করতে করতে তারা নিজেদের বাস্তব চেহারা বা জীবনকে তুচ্ছ ভাবতে পারে, যা ভবিষ্যতে আত্মবিশ্বাসের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

চুরি হওয়া সৃষ্টিশীলতা ও তার দুঃখ

ঘিবলি ফিল্টার আমাদের আনন্দ দিলেও, শিল্পী সমাজের বড় একটি অংশ আজ তাদের সৃষ্টি চুরি হওয়ার দুঃখ বয়ে বেড়াচ্ছে।
বিশিষ্ট ডিজিটাল আর্টিস্ট এবং অ্যানিমেটর লিনা হোয়াং এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমরা শিল্প সৃষ্টি করি আত্মা ঢেলে, অনুভূতি দিয়ে। যখন এআই সেই শিল্প কপি করে একটা মজার খেলা বানায়, তখন মনে হয় কেউ যেন আমাদের আত্মাকে হালকাভাবে নিচ্ছে।

এমন অনুভূতি কেবল লিনার একার নয়। সারাবিশ্বের হাজার হাজার স্বাধীন শিল্পী আজ এই চুরি হওয়া সৃষ্টিশীলতার বিরুদ্ধে নিজেদের লড়াই করছেন। প্রযুক্তির অগ্রগতিকে থামানো সম্ভব না হলেও, এর নৈতিক দিকগুলো নিয়ে আমাদের সচেতন হওয়া আবশ্যক। কারণ শিল্প শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি একেকটি মানুষের জীবন ও আত্মার প্রতিফলন।

ভবিষ্যতের সতর্ক বার্তা

যদি আমরা এখনই প্রযুক্তির ব্যবহারে সচেতন না হই, তাহলে ভবিষ্যতে ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার, শিল্পের অসম্মান এবং সামাজিক বিভাজন আরও বাড়তে পারে।
ডিজিটাল রাইটস অ্যাডভোকেসি গ্রুপ Electronic Frontier Foundation (EFF) স্পষ্ট করে বলেছে, ব্যক্তিগত ডেটা ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও সম্মতির প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা না হলে, সাধারণ মানুষই একদিন প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় শিকার হয়ে উঠবে।

সুতরাং ঘিবলি ফিল্টারে ছবি আপলোড করার আগে শুধু মজা নয়, একটু থেমে ভেবে দেখা জরুরি, আমি কী আমার তথ্য, আমার সম্মান, আমার ভবিষ্যত নিরাপত্তাকে একটি ক্লিকের বিনিময়ে বিলিয়ে দিচ্ছি না তো?

নিরাপদ থাকার কয়েকটি পরামর্শ

বিশেষজ্ঞদের মতে, কিছু সহজ নিয়ম মেনে চললে এই বিপদের আশঙ্কা অনেকাংশে কমানো সম্ভব:

  • কখনোই নিজের বা অন্যের ব্যক্তিগত ছবি অজানা বা সন্দেহজনক অ্যাপে আপলোড করবেন না।
  • কোনো ফিল্টার অ্যাপ ব্যবহারের আগে তার প্রাইভেসি পলিসি পড়ে দেখুন, কীভাবে তারা আপনার তথ্য সংরক্ষণ করে।
  • সম্ভব হলে অ্যাপ্লিকেশনে (ডাটা ডিলিট) অনুরোধ করার অপশন থাকলে সেটি ব্যবহার করুন।
  • নিজের ছবি ব্যবহারের আগে ভেবে নিন, আপনার কি সত্যিই দরকার এই কাজটি?
  • প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি নিজের বাস্তব জীবনের সম্মান ও সুরক্ষার বিষয়টিও সমানভাবে গুরুত্ব দিন।

শেষ কথা

ঘিবলি ফিল্টারের রঙিন জগত আমাদের এক মুহূর্তের আনন্দ দেয়, এক ক্লিকেই কল্পনার রাজ্যে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু সেই আনন্দের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিপদের ছায়াকে অগ্রাহ্য করা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। শিল্পীর সম্মান, নিজের ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা, আর ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বিপদ, সবকিছু মিলিয়ে আমাদের দায়িত্ব এখন আরও বেশি।

জীবন নিয়ে খেলবেন না! কয়েক সেকেন্ডের মজার জন্য নিজের পরিচয়, নিজের পরিশ্রম, নিজের সম্ভাবনা এক মুহূর্তেই অন্যের হাতে তুলে দেবেন না। মনে রাখুন, আনন্দ তখনই প্রকৃত হয় যখন তা নিরাপদ থাকে। সচেতন হন, সতর্ক থাকুন, আর জীবনটাকে বাঁচান প্রযুক্তির অদৃশ্য ফাঁদ থেকে।

Shares:
Leave a Reply