তাবলিগে দাওয়াত ও একতার গুরুত্ব

তাবলিগে দাওয়াত ও একতার গুরুত্ব

মতামত

কেরামত আলী

2024-12-26

তাবলিগ জামাত একটি অরাজনৈতিক ধর্মভিত্তিক সংগঠন। তাবলিগ জামাত অর্থ ‘ধর্মপ্রচারকদের সমাজ’, যারা মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকে। ১৯২৬ সালে দেওবন্দপন্থি আলেম মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভি ভারতের মেওয়াতে ‘তাবলিগ জামাত’ প্রতিষ্ঠা করেন। এর মূলনীতি ৬টি– কালিমা, নামাজ, ইলম ও জিকির, একরামুল মুসলিমিন, ইখলামে নিয়ত, দাওয়াত ও তাবলিগ। ওই সংগঠনের স্লোগান হলো– হে মুসলমান, (সত্যিকারের) মুসলমান হও। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত সুরা আল ইমরান-১১০ ও হা-মীম আস্সাজদাহ-৩৩ আয়াত অনুসারে তাদের কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম চলে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের প্রায় ১৮০টি দেশে। তবে ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’-এর হিসাব অনুসারে, ১৫০টিরও অধিক দেশে তাবলিগ জামাতের কয়েক কোটি অনুসারী রয়েছে। বাংলাদেশে তাবলিগ জামাত ১৯৪৬ সালে ঢাকার কাকরাইল মসজিদে প্রথম ইজতেমা শুরু করে। বিভিন্ন সালে বিভিন্ন মসজিদে হওয়ার পর একটু বড় পরিসরে ১৯৬০ সালে ঢাকার রমনা উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৬ সালে রমনা উদ্যানের পরিবর্তে টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে ‘পাগার’ নামক গ্রামের খেলার মাঠে আয়োজন করা হয় বার্ষিক ইজতেমা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে ১৬০ একর জমির ওপর আয়োজিত হয়ে আসছে ইজতেমা, যা ১৯৮০ সালে বিশ্ব ইজতেমার মর্যাদা পায়। প্রতিবছর প্রায় অর্ধশত দেশের মুসল্লিদের অংশগ্রহণে নিয়মিত ২৫ থেকে ৩০ লক্ষাধিক মুসল্লি বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণ করেন।

তাবলিগ জামাতের দ্বন্দ্ব সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। ২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর মাওলানা সাদ কান্ধলভি ও মাওলানা জুবায়ের আহমেদের অনুসারীদের মধ্যে পরস্পর হামলায় চারজন নিহত ও অনেক আহত হওয়ার পরই তাবলিগ জামাত নিয়ে সারাবিশ্বে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তার আগে ২০১৭ সালের নভেম্বরে  কাকরাইল মসজিদে দুই গ্রুপের হাতাহাতি ও ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর সাদ ও জুবায়েরপন্থিদের সংঘর্ষে ১ জন নিহত ও হাজার হাজার মানুষ আহত হয়। তবে এসব ঘটনার সূত্রপাত সাদ কান্ধলভির কয়েকটি ফতোয়াকে কেন্দ্র করে। যার মধ্যে ‘পারিশ্রমিক নিয়ে দ্বীন শেখানো দ্বীন বিক্রির নামান্তর’ ফতোয়াটি অন্যতম। তা ছাড়া ২০১৫ সালে তাবলিগের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভির প্রপৌত্র মাওলানা সাদ কান্ধলভি শূরায়ে নিজাম ভেঙে দিয়ে ‘নিজেকে একক আমির’ ঘোষণা দিলে শূরায়ে নিজামের অন্যতম সদস্য বাংলাদেশের মাওলানা জুবায়ের আহমেদ ২০১৮ সালে তাঁকে বাংলাদেশের মাটিতে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেন। যার জের ধরেই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। 
তাবলিগ জামাতে সাদ ও জুবায়েরপন্থিদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সমাধান করা এখন সময়ের দাবি। তাদের সমস্যা সমাধানকল্পে ঢাকার কাকরাইল মসজিদ জুবায়েরপন্থিদের দিয়ে সাদপন্থিদের জন্য আলাদা মসজিদের ব্যবস্থা করা। প্রতিবছর সম্ভাব্য ২০ ডিসেম্বর ও ২০ জানুয়ারি বিশ্ব ইজতেমা নির্ধারণ করে পালাক্রমে জুবায়ের ও সাদপন্থিদের মধ্যে বণ্টন করা; তবে যে তারিখই হোক না কেন, দুই ইজতেমার মাঝখানে অবশ্যই এক থেকে দেড় মাসের ব্যবধান থাকতে হবে। প্রতিবছর ‘জোড় ইজতেমা’র জন্যও এরূপ পালাক্রমে তারিখ নির্ধারণ করা। জুবায়ের ও সাদপন্থি দুই গ্রুপ একত্র না হওয়া পর্যন্ত এরূপ তারিখ নির্ধারণ করে কার্যক্রম চলমান রাখা।

বিশ্ব ইজতেমা কোনোক্রমেই যাতে বন্ধ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা। তবে তাবলিগ জামাতের ভাইদের কিছু বিষয়ে সজাগ থাকা দরকার। যেমন– কোরআন ও সহিহ হাদিস মেনে চলার চেষ্টা; শিরক ও বিদআতমুক্ত থাকা, দেশের ক্রান্তিলগ্নে অবদান রাখা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ থাকা। সর্বোপরি বিভিন্ন দেশের ইসলামী সংগঠনের সঙ্গে সংঘবদ্ধ থেকে একই কাতারে শামিল হয়ে কাজ করা। এরূপ কার্যক্রম পরিচালনা করলে তাবলিগ জামাতের মধ্যে আর কোনো দ্বন্দ্ব থাকবে না বলে আমি বিশ্বাস করি।

কেরামত আলী: প্রভাষক, রোভারপল্লী ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর
keramotali2004@gmail.com

© Samakal
Shares:
Leave a Reply