
নার্স ব্যস্ত মোবাইল ফোনে ময়না হারালেন ছেলে
সারাদেশ
চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি ও গোমস্তাপুর সংবাদদাতা 2025-01-11
বিয়ের ১০ বছর পর ময়না বেগমের কোলজুড়ে এসেছিল ছেলে আয়ান উদ্দিন। সন্তানের ডায়রিয়া হওয়ায় তাকে সুস্থ করার জন্য তিনি এসেছিলেন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। নার্সদের অবহেলায় তাঁর সন্তানকে হারাতে হলো বলে বিলাপ করছিলেন তিনি। এ সময় নার্সদের শাস্তি চাইলেও আর কিছু বলতে পারেননি। সন্তানের মরদেহ সামনে রেখে শুধুই তাকিয়ে ছিলেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গতকাল শনিবার এমন ঘটনা ঘটেছে। পরে তিন নার্সকে দায়িত্ব থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসাসেবা বাদ দিয়ে মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকা এবং অবহেলায় শিশুর মৃত্যুর অভিযোগে এ ব্যবস্থা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। শিশুটির বাবা থানায় মামলাও করেছেন।
ঘটনার পর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উত্তেজনা দেখা দেয়। শিশুর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এসে বিক্ষোভ শুরু করে। একপর্যায়ে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তিন নার্সকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয় একটি কক্ষে। এ ঘটনায় সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া তিনজন হলেন সিনিয়র স্টাফ নার্স আম্বিয়া খাতুন, মজিদা খাতুন ও আমেনা খাতুন।
মারা যাওয়া ১৬ মাস বয়সী শিশু মো. আয়ান উদ্দিন রহনপুর পৌর এলাকার মুক্তাশা হলপাড়ার আমিন ইসলামের ছেলে। আমিন জানান, গত বুধবার অসুস্থ অবস্থায় ছেলেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করান। শুক্রবার রাতে তার স্যালাইন শেষ হলে নার্সদের কাছে আরও লাগবে কিনা বা করণীয় কী, তা জানতে চান। তারা বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে মোবাইল ফোনে ব্যস্ত ছিলেন।
এ সময় কর্তব্যরত কোনো চিকিৎসককেও পাওয়া যায়নি। আমিন অভিযোগ করে বলেন, যথাসময়ে স্যালাইন না দেওয়ায় তাঁর ছেলে শনিবার সকালে মারা যায়। এ ঘটনায় তাঁর স্বজনসহ স্থানীয় বাসিন্দারা বিক্ষোভ করেন। পরে পুলিশ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও রাজনৈতিক দলের নেতারা গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
পৌরসভার সাবেক মেয়র ও বিএনপি নেতা মো. তারিক আহম্মেদ বলেন, ফুটফুটে একটি শিশু নার্সদের অবহেলায় মারা গেল, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। অভিযুক্তদের শাস্তি হতে হবে; তাহলে আর কেউ মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকবে না। জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আসাদুল্লাহ আহম্মেদের ভাষ্য, জনগণের টাকায় তাদের বেতন হয়। অথচ সেবা বাদ দিয়ে ফোনে আসক্ত থাকবে, তা মেনে নেওয়া হবে না।
১০ বছর চেষ্টার পর আমিনের সংসারে আসে আয়ান। এ তথ্য জানিয়ে তাঁর স্বজন শামিম হোসেন বলেন, ‘ফুটফুটে ও শান্ত প্রকৃতির শিশুটিকে ওরা একেবারেই শান্ত করে দিল।’ প্রত্যক্ষদর্শী এক রোগী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বারবার বলার পরও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কেউ কর্ণপাত না করায় এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হয়েছে। এখানকার কেউ চায় না, কোনো রোগী চিকিৎসা নিক। কিছু হলেই অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়।
স্থানীয় বাসিন্দা রমজান আলীর ভাষ্য, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যখনই আসেন, তখনই দেখেন, নার্সরা কেউ খোশ গল্পে, আবার কেউ মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত। তাদের কাছে সহযোগিতা চাইলে বিরক্ত হন। আজিজুর রহমান বলছিলেন, আয়ানের মৃত্যুর বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মানুষে ভরে যায়। তারা বিক্ষোভ শুরু করলে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়।
এরপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে উপজেলা বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মীরা এসে বিক্ষুব্ধদের শান্ত করেন। এ সময় কর্তৃপক্ষকে অভিযুক্তদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে চাপ দেন। একপর্যায়ে তিন নার্সকে সাময়িক অব্যাহতি দেয় কর্তৃপক্ষ। এ ব্যাপারে নার্সদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে পরে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ায় তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরএমও ইসমাঈল হোসেন লিংকন বলেন, যারা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তদন্তসাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা একটি অফিস আদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন এবং অভিযুক্তদের পাঠিয়েছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট সাইফুল রেজা বলেন, কাজে ফাঁকি দিয়ে বা কর্তব্যকাজ বাদ দিয়ে ফোন নিয়ে কিংবা ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ততা দেখানো দায়িত্বের প্রতি অবহেলার শামিল। শুধু কর্মক্ষেত্রে নয়, সবারই মোবাইল ফোনের আসক্তি কাটিয়ে ওঠা জরুরি।