
পটুয়াখালীতে হচ্ছে আধুনিক জাহাজ নির্মাণ কারখানা
সমৃদ্ধি
মেসবাহুল হক 2025-01-10
শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশন (বিএসইসি) এবং অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক জেন্টিয়াম সলিউশন একটি যৌথ কোম্পানি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। এ কোম্পানি গঠনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিদেশি বিনিয়োগ ও টেকনোলজি ট্রান্সফারের মাধ্যমে পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরের পাশে একটি আন্তর্জাতিক মানের আধুনিক ও টেকসই জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত কারখানা স্থাপন করা। এটি বাস্তবায়নে কারিগরি সহায়তা দেবে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সিএমএন নেভাল।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের এ উদ্যোগটি নিয়ে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি অন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার পায়রা বন্দর এলাকায় চর নিশানবাড়িয়া ও মাধুপাড়ায় ১০১ একর খাসজমি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নামে বরাদ্দ করা হয়েছিল। এই জমি জাহাজ নির্মাণ কারখানা (শিপইয়ার্ড) নির্মাণের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সিএমএন নেভাল জেন্টিয়াম সলিউশনকে জাহাজ নির্মাণ কারখানা স্থাপনে কারিগরি সহায়তা দেবে।
এ সম্পর্কিত প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫২ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় যা ১৮ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। কারখানাটির ৭০ শতাংশ মালিকানা থাকবে জেন্টিয়াম সলিউশনের, বাকি ৩০ শতাংশ বিএসইসির। প্রথম অবস্থায় ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে। এর জেন্টিয়াম সলিউশন দেবে ৩৫ কোটি এবং ১৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে বিএসইসি। শিল্প মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, শিপ বিল্ডিং এবং শিপ রিপেয়ারিং সরবরাহ ও সেবা প্রদান ইতোমধ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি সংস্থা ‘নৌ কল্যাণ ফাউন্ডেশন ট্রেডিং কোম্পানির সঙ্গে জেন্টিয়াম সলিউশনের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
বৈঠকের কার্যপত্রে উল্লেখ করা হয়, বিদেশি বিনিয়োগ ও টেকনোলজি ট্রান্সফারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। বর্তমানে অভ্যন্তরীণভাবে যেসব নৌযান তৈরি করা হয়, তার মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৪০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত যাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে নতুন প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে আধুনিক নৌযান রপ্তানি করতে পারবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সভায় তিনটি শর্তে প্রস্তাবিত যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাবে সম্মতি দেওয়া হয়। শর্তগুলো হচ্ছে– এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের কোনো আর্থিক সংশ্লিষ্টতা থাকবে না। কোনো কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত না হলে ১০১ একর জমি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে ফেরত দিতে হবে। তাছাড়া প্রকল্পটি যথাযথ বাস্তবায়নে অর্থের সংস্থান রয়েছে। তাই জেন্টিয়াম সলিউশনের ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিকল্পনা এবং অর্থায়ন পরিকল্পনা পর্যালোচনা করে দেখা হবে।
পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরের কাছে একটি জাহাজ নির্মাণ কারখানা স্থাপন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুত একটি প্রকল্প। ২০১৪ সালে পটুয়াখালী সফরের সময় তিনি এখানে শিপইয়ার্ড নির্মাণের ঘোষণা দেন। ২০১৫ সালে শিল্প মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে তিনি এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলেন। শিল্প মন্ত্রণালয় এটি অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়।
জানা গেছে, জাহাজ নির্মাণ শিল্পে প্রচুর শ্রমিকের দরকার হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে প্রথম পর্যায়ে আঞ্চলিক ও স্থানীয় প্রায় ২ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। জেন্টিয়াম সলিউশনের পাশাপাশি এটি বাস্তবায়নে ডাচ প্রতিষ্ঠান ডামেন শিপইয়ার্ড গ্রুপের থাকার কথা রয়েছে। জেন্টিয়াম-ডামেনের মতো বিশেষায়িত কোম্পানির সঙ্গে কাজ করে বাংলাদেশের শ্রমিকরা দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ পাবেন। উন্নত বিশ্বের প্রযুক্তি বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হবে। এতে তারা দেশে ব্যবহারের জন্য এবং দেশের বাইরে রপ্তানির জন্য বাংলাদেশ সরকারের উচ্চমানের জাহাজ নির্মাণ লক্ষ্য বাস্তবায়নে সহযোগিতা করবেন। আমদানির বিকল্প জাহাজ তৈরি করে তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিশ্বমানের জাহাজ সরবরাহ করবেন। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম জাহাজ নির্মাণ করতে বাংলাদেশে নির্ভরযোগ্য ও প্রতিযোগিতামূলক সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নয়নে তারা ভূমিকা রাখবেন। শিল্প মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, জাহাজ নির্মাণ শিল্পে অতীতে বাংলাদেশের সাফল্য রয়েছে। আশার কথা, বাংলাদেশ আবার সেই গৌরবোজ্জ্বল
অতীত ফিরিয়ে আনার পথে। এরই মধ্যে বাংলাদেশে নির্মিত জাহাজ ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪ নম্বরে। জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি চীন, কোরিয়া এবং জাপানের তুলনায় অনেক কম। কিন্তু দক্ষতার দিক দিয়ে এ দেশের শ্রমিকরা অন্য দেশ থেকে বহু গুণ এগিয়ে। আন্তর্জাতিক বাজার বিবেচনায় বাংলাদেশে নির্মিত জাহাজের নির্মাণ ব্যয় সর্ববৃহৎ জাহাজ নির্মাণকারী দেশ চীনের তুলনায় ১৫ শতাংশ কম। আন্তর্জাতিক বাজারে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে ২০০ বিলিয়ন ডলারের শতকরা ২ ভাগ অর্ডার পাওয়া সম্ভব হয়, তাহলে বাংলাদেশ জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে।
সম্প্রতি জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থার (আইএমও) জারিকৃত আইএসপিএস কোডের কারণে ২৫ বছরের বেশি পুরোনো জাহাজ চলাচল করার অনুমতি হারিয়েছে। আইএমওর দেওয়া নির্দেশনার ফলে কেবল ইউরোপীয় দেশগুলোতেই কিছুদিনের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার জাহাজ অকেজো হয়ে পড়বে ও এর বিকল্প হিসেবে নতুন জাহাজ সংযুক্ত করতে হবে। আর এ জাহাজ নির্মাণে বাংলাদেশই হতে পারে অন্যতম বিকল্প।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বের জাহাজ নির্মাণ বাজারের আকার ১ হাজার ৬০০ বিলিয়ন ডলারের। যদি বাংলাদেশ মাত্র ১ শতাংশ অর্জন করতেও সক্ষম হয়, তবে তা হবে ১৬ বিলিয়ন ডলারের। বাংলাদেশ যদি বিশ্বের ছোট জাহাজ নির্মাণ বাজারের শতকরা ১ ভাগও নিজেদের দখলে নিতে পারে, তা হবে ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি।