কল্পনা করুন, আপনি বাংলাদেশের কোনো প্রত্যন্ত হাওড় অঞ্চলে বসে ইউটিউবে ৪কে ভিডিও স্ট্রিম করছেন, তাও কোনো বাফারিং ছাড়াই। অথবা কোনো পার্বত্য গ্রামে বসে অনায়াসে ভিডিও কনফারেন্স করছেন দেশের বাইরের কারো সঙ্গে। এমন দৃশ্য যদি এক বছর আগেও কেউ কল্পনা করত, আমরা হয়তো বলতাম, ধুর! গ্রামের মানুষ আর এতটা ফাস্ট ইন্টারনেট? অথচ এখন সেই কল্পনা’ই বাস্তব হয়ে ধরা দিচ্ছে বাংলাদেশের মাটিতে।

কার হাত ধরে? স্টারলিংক-এর হাত ধরে।

স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান স্টারলিংক অবশেষে বাংলাদেশে তাদের যাত্রা শুরু করেছে। আর এই যাত্রা যেন দেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে একেবারে নতুন এক যুগে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে।

একটি ফোন কল বদলে দিল বাংলাদেশের ডিজিটাল ভবিষ্যৎ!

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানিয়েছেন জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানের সময়, বারবার ইন্টারনেট বন্ধের অভিজ্ঞতা থেকে সাধারণ মানুষের ভেতর একধরনের প্রতিবাদ তৈরি হয়েছিল। তখন থেকেই শুরু হয় আলোচনা, কিভাবে বাংলাদেশে একটি নিরবচ্ছিন্ন, স্বাধীন, আর প্রতিনিয়ত সরকারের নিয়ন্ত্রণে না থাকা ইন্টারনেট ব্যবস্থা আনা যায়।

ঠিক তখনই অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, নিজেই ফোন করেন ইলন মাস্ককে বিশ্বখ্যাত উদ্যোক্তা ও স্পেসএক্সের কর্ণধারকে। ফোনে অনুরোধ করেন ৯০ দিনের মধ্যে স্টারলিংক চালুর ব্যবস্থা নিতে। ভাবা যায়? একটা ফোন কল, আর বাংলাদেশের ইন্টারনেট দুনিয়ায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা!

গ্রামে ১০০ এমবিপিএস! শহরেও যা স্বপ্ন, তা এখন বাস্তবতায় গ্রামবাংলায়!

আমাদের দেশের বাস্তবতা এমন ঢাকার বাইরে গেলে ফাইবার-নির্ভর ইন্টারনেট প্রায় দুর্লভ। এমনকি ফাইবার নেটওয়ার্কের বিস্তৃতিটুকুও যেটুকু রয়েছে, তার বড় অংশই টেলকো-গ্রেড নয়। টাওয়ারগুলোর অধিকাংশ এখনো মাইক্রোওয়েভ প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল, যার ধারণক্ষমতা সীমিত।

এই প্রেক্ষাপটে স্টারলিংকের আগমন যেন আক্ষরিক অর্থেই (আকাশ থেকে পড়া নেট।) কেননা, এটি পুরোপুরি স্যাটেলাইট-নির্ভর। ফলে ফাইবার লাগছে না, মোবাইল টাওয়ারের ওপর নির্ভরতা নেই, আর লোডশেডিং হলে ইন্টারনেট চলে যাবে এই দুঃস্বপ্নেরও অবসান ঘটছে।

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের ভাষায়, লোডশেডিংয়ের সাথে সাথে যেমন আমাদের ঘরে ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়, স্টারলিংকের ক্ষেত্রে তা হবে না। এমনকি মোবাইল টাওয়ারের ব্যাটারি শেষ হলেও, স্টারলিংক থাকবে চালু।

কেন ISP গুলোর ঘুম উড়ে যাচ্ছে?

দেশের প্রচলিত ইন্টারনেট সেবাদাতারা, বিশেষ করে ছোটখাটো ISP প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য স্টারলিংক যেন এক দুঃস্বপ্নের নাম। কারণ তারা যেখানে দিনের পর দিন গ্রাহক ধরে রাখতে লাইন ফিক্সিং, ফাইবার কাটার সমস্যা, ব্যান্ডউইথ ওঠানামার মতো ঝামেলায় ভোগে, সেখানে স্টারলিংকের নিরবচ্ছিন্ন উচ্চগতির সেবা নতুন এক প্রতিযোগিতা তৈরি করছে।

তাদের একমাত্র অস্ত্র ছিল (লোকাল সাপোর্ট।) কিন্তু এখন তো গ্রাহক জানে, স্টারলিংকের রাউটার একসঙ্গে ২৫০ জন পর্যন্ত ইউজারকে নেট দিতে পারে! সেই সঙ্গে ডাউনলোড স্পিড প্রায় ৯৭ এমবিপিএস! অথচ অনেক আইএসপি তো আজও ৫ এমবিপিএস নিশ্চিত করতে পারে না।

একটি স্যাটেলাইট প্রযুক্তির জয়যাত্রা

স্টারলিংক প্রকৃতপক্ষে একটি স্যাটেলাইট ক্লাস্টার। পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে থাকা প্রায় ৭ হাজারের বেশি উপগ্রহ প্রতিনিয়ত ঘুরছে, এবং এর মাধ্যমে উচ্চগতির ইন্টারনেট পৌঁছে যাচ্ছে গ্রহের প্রত্যন্ত কোনায় কোনায়।

২০১৯ সালের মে মাসে যখন প্রথমবার স্টারলিংক ৬০টি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে, তখন অনেকেই ভাবেনি এটি এত দ্রুত জনসাধারণের কাছে পৌঁছে যাবে। অথচ মাত্র ৫ বছরের ব্যবধানে, বাংলাদেশও এখন সেই বৈপ্লবিক ইন্টারনেট প্রযুক্তির আওতায়।

বাংলাদেশের পার্বত্য থেকে উপকূল, সবখানে (নেট-আলো) জ্বলবে!

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের অন্তত ৬৫ শতাংশ টেলিযোগাযোগ টাওয়ার এখনো ফাইবার-নেটওয়ার্কে সংযুক্ত নয়। অর্থাৎ এখানেই সুযোগ দেখেছে স্টারলিংক। বিশেষ করে যেসব অঞ্চল ভৌগোলিকভাবে দুর্গম চট্টগ্রামের পার্বত্য জেলা, উপকূলীয় চরাঞ্চল, কিংবা হাওর ও দ্বীপ অঞ্চল, এইসব জায়গায় ফাইবার পৌঁছানো অসম্ভব না হলেও, সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল।

স্টারলিংক সেই সময় ও ব্যয়ের বেড়াজাল ছাড়িয়ে গিয়েছে। তাদের কিট বা সংযোগ সরঞ্জাম বসিয়ে নিলেই, আর কোনো ঝামেলা নেই। আপনি তখন সেই একই নেটওয়ার্কে যুক্ত, যেটা যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসেও চলছে!

আরো বড় চমক: শহর-গ্রাম ডিজিটাল বিভাজন কমিয়ে আনছে স্টারলিংক!

শুধু গ্রামের মানুষই না, শহরের মানুষরাও উপকৃত হবেন স্টারলিংক ব্যবহার করে। কারণ বাংলাদেশের মোবাইল নেটওয়ার্কেও অনেক সময় সমস্যা দেখা দেয়, বিশেষ করে হাইওয়ে বা চলন্ত বাসে ইন্টারনেট কার্যকর থাকে না। আবার অফিসে বা হাই-ডিমান্ড জোনে বিটিএস লোড হয়ে গেলেই দেখা যায় ৪জি থাকলেও গতি নেই।

এমন পরিস্থিতিতে স্টারলিংক যেন এক উড়ন্ত ওয়াইফাই! সোজা কথায়, তারবিহীন এক মুক্ত জগত, যেখানে আপনার সংযোগ নির্ভর করছে না কোনো স্থানীয় লাইনের ওপর।

স্টারলিংকের দাম কত? গ্রামীণ মানুষের নাগালে থাকবে?

এখানেই সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন উঠেছে এত আধুনিক প্রযুক্তি, কিন্তু খরচ কত?  স্টারলিংকের প্রাথমিক কিট, যেটা ডিশ, রাউটার ও স্ট্যান্ডসহ আসে, তার দাম প্রায় ৪০০ মার্কিন ডলার। আর মাসিক সাবস্ক্রিপশন ফি ৫০ থেকে ১০০ ডলারের মধ্যে, লোকেশন অনুযায়ী।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটাই সবচেয়ে বড় বাধা। কারণ এখনো দেশের বহু মানুষ ৫০০ টাকার নিচে ইন্টারনেট প্যাকেজ খোঁজেন। তবে ভালো খবর হচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনা চলছে যাতে কোনো (রেন্টাল মডেল) চালু করা যায়, অর্থাৎ এককালীন দাম না দিয়ে মাসে মাসে কিস্তিতে দেওয়া যায় স্টারলিংক কিট।

বেশ কিছু এনজিও, বিশেষ করে BRAC এবং Grameen Communications, ইতিমধ্যে প্রস্তাব দিয়েছে তারা রিমোট এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্টারলিংক বসাবে নিজ খরচে।

একদম গ্রামের স্কুলে বসে ছেলেমেয়েরা NASA লাইভ দেখবে এটাই সেই পরিবর্তন!

সরকারি নীতিমালায় কী অবস্থান নিচ্ছে বাংলাদেশ?

টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (BTRC) শুরুতে স্টারলিংক প্রসঙ্গে কিছুটা নিরব ছিল। কিন্তু এখন তারা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে এই সেবা যদি দেশের স্বার্থে হয়, নিয়ন্ত্রিত-ভিত্তিতে বৈধভাবে আসে, তাহলে তারা এটিকে স্বাগত জানাবে।

বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে:

  • স্টারলিংক সিগন্যাল রিসিভারদের কোনো আলাদা টাওয়ার লাইসেন্স লাগবে না।
  • সীমান্তবর্তী এলাকায় সিগন্যাল ব্যবহারে কোনো সামরিক বিধিনিষেধ থাকছে না।
  • যারা রিমোট এলাকায় সামাজিক বা শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে নেট দিতে চায়, তাদের জন্য রয়েছে ট্যাক্স ছাড়।

এমন সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ায়, অন্যদিকে দেশীয় আইএসপি গুলোকেও চাপের মুখে ফেলে।

ISP গুলোর জন্য স্টারলিংক এক অভিশাপ, না আশীর্বাদ?

বাংলাদেশে প্রায় ২ হাজার লাইসেন্সধারী ISP রয়েছে। তাদের অনেকেই কাজ করেন মফস্বল শহরে বা জেলা পর্যায়ে। তারা দীর্ঘদিন ধরে অপারেট করছে টাওয়ার বা ল্যান্ডলাইন নির্ভর ফাইবার অপটিক প্রযুক্তিতে।

স্টারলিংক এলে প্রথম ধাক্কাটা তারাই পাচ্ছে। কারণ অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন প্রশ্ন তুলছে (আমরা যদি বাড়তি খরচ করেও গ্রামে লাইন পৌঁছে দিই, কিন্তু কেউ যদি স্টারলিংকের ডিস বসিয়েই নেট চালায়, তাহলে তো আমাদের ব্যবসা শেষ!)

কিন্তু এখানেই রয়েছে অন্য এক সম্ভাবনা। স্টারলিংকের একটি রাউটার ২৫০ জনকে ইন্টারনেট দিতে পারে, মানে একটি ছোট বাজার বা স্কুল-অঞ্চল কভার করা সম্ভব। তাহলে স্থানীয় আইএসপিরা চাইলে স্টারলিংককে ব্যাকবোন হিসেবে ব্যবহার করতে পারে, এবং নিজেদের সাবস্ক্রিপশন মডেল চালু রাখতে পারে।

অর্থাৎ প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, বরং স্টারলিংক হতে পারে সহযোগী।

যেসব খাতে বড় বিপ্লব ঘটবে: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ও ই-কমার্স

১. শিক্ষা: দুর্গম অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীরা আর শুধু পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ডিজিটাল ক্লাসরুম, লাইভ সেশন, Khan Academy, Google Classroom সবকিছুর প্রবেশ ঘটবে স্যাটেলাইট নেটের মাধ্যমে। এমনকি গ্রামের কোনো হাইস্কুল থেকেও এখন MIT-র অনলাইন কোর্সে অংশ নেওয়া সম্ভব।

২. স্বাস্থ্য: গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে টেলিমেডিসিনের পথ খুলে যাচ্ছে। একজন ডাক্তার রাজধানী থেকে রিমোট এলাকায় বসে রোগী চেকআপ করতে পারবেন ভিডিও কলে। কোনো জটিল রিপোর্ট স্ক্যান করে সাথে সাথে শহরের ল্যাবে পাঠানো যাবে।

৩. ই-কমার্স ও ফ্রিল্যান্সিং: আগে যেখানে গ্রামে বসে অনলাইন ব্যবসা করা বা ফাইভার/আপওয়ার্কে কাজ করা কল্পনাতীত ছিল, এখন তা বাস্তব। শুধু একটি স্টারলিংক সংযোগ থাকলেই, একজন তরুণ তার গ্রামের বসেই হয়ে উঠতে পারে আন্তর্জাতিক ফ্রিল্যান্সার।

চ্যালেঞ্জ কি একেবারেই নেই?

অবশ্যই আছে।

  • মূল্য এখনো অনেকের নাগালের বাইরে।
  • সরকারি নীতিমালার স্থায়ীত্ব নিয়ে সন্দেহ আছে।
  • দেশীয় মোবাইল অপারেটর বা ক্যাবল ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এটি বাধা দিতে পারে।
  • সাইবার নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে কারণ স্টারলিংক সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

তবে এসব চ্যালেঞ্জ যেমন আছে, তেমনি নতুন সমাধানও আসবে। প্রযুক্তি কখনো থেমে থাকে না। এক সময় মোবাইল ফোনও ছিল লাখ টাকার, এখন হাতের মুঠোয় ৩ হাজারে মিলছে স্মার্টফোন!

শেষ কথা:

একটি সময় ডিজিটাল বাংলাদেশ ছিল স্লোগান। এখন সেটাই হয়ে উঠেছে বাস্তব। স্টারলিংক ইন্টারনেটের আগমন বাংলাদেশের জন্য শুধুই একটি নতুন প্রযুক্তি নয়, এটি একটি সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন।

যেখানে গ্রামের ছেলেটিও বিশ্ব মানের শিক্ষা নিতে পারবে, মা তার অসুস্থ ছেলেকে ভিডিও কলে চিকিৎসা দেখাতে পারবে, আর তরুণ-তরুণীরা নিজের ঘরে বসেই বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে।

এটাই তো ডিজিটাল যুগের আসল জয়!

তথ্যসূত্র:

  • The Daily Star, Prothom Alo, TechCrunch, SpaceX Official, Bangladesh Telecommunication Regulatory Commission (BTRC), Interviews with Fayez Ahmad Tayyab.
  • Written & Researched by (Writesomnia)

আপনার মতামত কী? স্টারলিংক কি বদলে দিতে পারবে বাংলাদেশের ডিজিটাল ভবিষ্যৎ? নিচে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না!

Shares:
Leave a Reply