বাদীর ছদ্মবেশে বিবাদী

বাদীর ছদ্মবেশে বিবাদী

সম্পাদকীয়

সমকাল ডেস্ক

2024-12-27

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের সুবিচারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ হইলেও ইতোপূর্বে গণহারে যেই সকল মামলা হইয়াছে, সেইগুলি লইয়া বিস্তর প্রশ্ন রহিয়াছে। বৃহস্পতিবারের সমকালে ৫ আগস্ট রাজধানীর বাড্ডায় শহীদ হওয়া আল আমিনের মামলার যেই বৃত্তান্ত প্রকাশ হইয়াছে, উহাও হতাশাজনক। আল আমিন হত্যাকাণ্ডে দুটি মামলা হইলেও তাঁহার পরিবার এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। দুইটি মামলার বাদী পৃথক; এজাহারে ঘটনাস্থলের সহিতও মিল নাই। এমনকি এজাহারে কী লিপিবদ্ধ রহিয়াছে, আসামি কাহারা, উহাও বাদীর অজানা। ইহার অর্থ হইল, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হইয়া এই মামলা দায়ের হইয়াছে। ইহাতে শহীদের সুবিচারপ্রাপ্তি যদ্রূপ কঠিন হইবে, নিরীহ নাগরিকের হয়রানির আশঙ্কাও তদ্রূপ বৃদ্ধি পাইবে। উপরন্তু মামলা-বাণিজ্যের পথই উন্মুক্ত হইবে কেবল। 

বস্তুত ৫ আগস্টের পর হইতেই শহীদদের হত্যাকাণ্ডসহ নানা অপরাধের মামলা হইয়াছে ব্যাপক হারে। আমরা দেখিয়াছি, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যেই সহস্রাধিক প্রাণ ঝরিয়াছে, ঐগুলির বিচারে অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের উদ্যোগ লইয়াছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাইতে যেই সকল মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হইয়াছে, সেইগুলির বিচারে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিচারের জন্য ইতোমধ্যে অনেক মামলা করা হইয়াছে; গ্রেপ্তারও হইয়াছেন অনেক। তবে উল্লেখযোগ্য মামলায় যদ্রূপ ঢালাও অপরাধী করা হইয়াছে, তাহা লইয়া ইতোমধ্যে নাগরিক সমাজ যেই উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছে, উহা যথার্থ। কারণ প্রকৃত অপরাধীর নামে মামলা না দিয়া প্রতিহিংসাবশত নিরপরাধ কাউকে আসামি করা হইলে মামলার মাধ্যমে সত্যিকার প্রতিকার বা অপরাধীর বিচারের প্রত্যাশা করা যায় না।

সমকালের প্রতিবেদনে আল আমিনের মামলার যেই বিবরণ প্রকাশ হইয়াছে, তাহাতে স্পষ্ট– মামলা দুইটি হীন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। একটি মামলার বাদী সম্পর্কে আলোচ্য শহীদের পিতৃব্য হইলেও অপরটির বাদী তাঁহার পরিবারের পরিচিতই নহে। উপরন্তু রহমান মাল ডিসেম্বরে আসিয়া আদালতে মামলাটি করিয়াছেন, যেইখানে আসামিদের ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না! সমকাল হইতে আসামিদের কয়েকজনের সহিত যোগাযোগ করা হইলে তাহারা আন্দোলন চলাকালে ঢাকাতেই না থাকিবার কথা জানাইয়াছেন।
ছাত্রদের আন্দোলনে বিরোধিতাকারী কিংবা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সহিতও যুক্ত নহেন, এইরূপ ব্যক্তিদের আসামির তালিকায় আনয়নের উদ্দেশ্য আর যাহাই হউক তাহা সৎ হইতে পারে না। এইরূপ মামলার বাদীরা যে বিবাদীর নামান্তর, উহা বুঝিবার জন্য বিশেষজ্ঞ হইবার প্রয়োজন নাই।

আমরা মনে করি, এই ধরনের মামলা যাচাই-বাছাই ব্যতীত গ্রহণ করা উচিত হইবে না। আমরা জানি, সুষ্ঠু তদন্ত করিয়া প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির না করিলে আসামিদের দোষী প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব। হত্যা মামলায় সম্পৃক্ততা, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও প্রাথমিক প্রমাণ ব্যতিরেকে মামলা করা হইলে অভিযুক্তদের কেবল হয়রানিই করা হইবে। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের শাসনামলে এই ধরনের ব্যাপক মামলা হইয়াছিল। আখেরে তাহাতে ক্ষতি বৈ লাভ হয় নাই। এমনকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অনেক মামলায় আমরা দেখিয়াছি, বিগত সময়ে কীভাবে অপরাধ না করিয়াও বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী দিন জেল খাটিয়া চলিয়াছেন।

এখন অন্য কেহ এইরূপ হয়রানির শিকার হউন, কাহারও কাম্য হইতে পারে না।  
আমরা অবশ্যই প্রত্যাশি করি, শহীদগণের পরিবার ন্যায়বিচার পাইবে। হত্যাকারীদের আইনের আওতায় না আনিলে অপরাধীরা যদ্রূপ নিষ্কৃতি পাইবে তদ্রূপ পুনরায় অপরাধ সংঘটনে উৎসাহিত হইবে। তজ্জন্য মামলাগুলির ক্ষেত্রে সঠিক ও যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করা উচিত। যাহারা শহীদদের পুঁজি করিয়া মামলা বাণিজ্য করিতে চাহে, তাহাদের বিষয়েও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সজাগ থাকিতে হইবে। আমরা প্রত্যাশা করি, সত্যিকার মামলা গ্রহণে পুলিশ যেরূপ তৎপর হইবে, অনুরূপ ভুয়া মামলার ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকিবে। 

© Samakal
Shares:
Leave a Reply