বায়ুদূষণে বছরে দেশে  মৃত্যু লাখের বেশি

বায়ুদূষণে বছরে দেশে মৃত্যু লাখের বেশি

বাংলাদেশ

সমকাল প্রতিবেদক

<time class="op-modified" dateTime="2025-01-19"2025-01-19
2025-01-19

বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। বায়ুদূষণ দেশে মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বায়ুদূষণে মৃত্যুর হার উচ্চ রক্তচাপ, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও তামাকের কারণে হওয়া মৃত্যুর হারকেও ছাড়িয়ে গেছে বলে নতুন এক গবেষণায় জানা গেছে। এটি রোধ করা গেলে দেশে প্রতিবছর ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৬ জনের অকালমৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। 

বায়ুদূষণের কারণে যত লোকের মৃত্যু হয়, তাদের ৪৮ শতাংশ ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরের বাসিন্দা। এসব স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে বিরাট অর্থনৈতিক ব্যয় জড়িত। যার মধ্যে উচ্চতর স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হ্রাস অন্তর্ভুক্ত। ২০১৯ সালে সার্বিকভাবে এই ব্যয় ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল, যা দেশের জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ। বায়ুদূষণ কমলে রক্ষা পাওয়া যাবে বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি থেকে।

ফিনল্যান্ডভিত্তিক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের (সিআরইএ) গবেষণায় এসব তথ্য জানা গেছে। বাংলাদেশে বায়ুদূষণে জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব-সংক্রান্ত এই গবেষণা প্রতিবেদন গতকাল শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করা হয়। সিআরইএ ও সেন্টার ফর অ্যাটমোসফেরিক পলিউশন স্টাডিজ (ক্যাপস) যৌথভাবে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত স্যাটেলাইটের তথ্য, আন্তর্জাতিক তথ্যভান্ডার ও সরকারি ওয়েবসাইটের তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে এই গবেষণা করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে গবেষণাপত্র তুলে ধরেন গবেষক দলের অন্যতম সদস্য জেমি কেলি।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়ুদূষণ (অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা বা পিএম ২.৫-এর উপস্থিতি) রোধ করা গেলে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৬ জনের মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। পাঁচ বছরের নিচের শিশুরা বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। এই দূষণ রোধ করা গেলে বছরে ৫ হাজার ২৫৪ শিশুর মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। এ ছাড়া হৃদরোগে ২৯ হাজার ৯২০ জন, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে ২৩ হাজার ৭৫ জন, সিওপিডিতে (ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী ব্যাধি) ২০ হাজার ৯৭৬ জন, নিউমোনিয়ায় ৯ হাজার ৭২০ জন এবং ফুসফুসের ক্যান্সারে ৩ হাজার ৬৩ জনের মৃত্যু রোধ করা সম্ভব।

গবেষণায় উঠে এসেছে, বায়ুদূষণজনিত অসুস্থতা হাঁপানির কারণে বছরে প্রায় ৬ লাখ ৬৯ হাজার মানুষকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যেতে হয়। এই দূষণের কারণে বছরে ২৬ কোটি ৩০ লাখ কর্মদিবস নষ্ট হয়। বায়ুদূষণের কারণে বছরে ৯ লাখ ৪৮৫ শিশুর অকাল জন্ম হয়। ৬ লাখ ৯৬ হাজার ৩৮৯ শিশু ওজন স্বল্পতায় ভোগে। বায়ুদূষণ না থাকলে বছরে মানুষের মৃত্যুহার ১৯ শতাংশ কমবে বলেও গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।

শহরাঞ্চলে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি। বায়ুদূষণের কারণে যাদের মৃত্যু হয়, তার মধ্যে ৪৮ শতাংশ ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরের। গ্রাম ও উপকূলীয় অঞ্চলে বায়ুদূষণ কম বলেও গবেষণায় উঠে এসেছে। বায়ুদূষণের কারণও তুলে ধরা হয়েছে এই গবেষণায়। এতে প্রথম কারণ হিসেবে শিল্পকলকারখানার বায়ুদূষণকে তুলে ধরা হয়েছে। এর পর রয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র, যানবাহনের দূষণ, নির্মাণকাজ, বর্জ্যসহ বিভিন্ন জিনিস পোড়ানোর ফলে বায়ুদূষণ। এ ছাড়া মৌসুমি ধূলিঝড় ও অন্য দেশ থেকে আসা দূষিত বায়ুও বাংলাদেশের বায়ুদূষণের কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে গবেষণায়। সিআরইএ-এর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশ্লেষক ও এই গবেষণার প্রধান গবেষক ড্যানিয়েল নেসান বলেন, বায়ুমানের সামান্য উন্নতিও জাতীয় পর্যায়ে বড় ধরনের স্বাস্থ্য সুবিধা দিতে পারে।

পরিবেশ বিগত সরকারের উন্নয়নের বলি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বিগত সরকারের উন্নয়নতত্ত্ব নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রশ্ন তুলতে হবে। শিল্প এলাকায় কারখানা না করে আবাসিক ও ফসলি এলাকায় করছে, এমন অসৎ ব্যবসায়ীরা সরকারের সঙ্গে আঁতাত করছে বলে অভিযোগ করেন আদিল মুহাম্মদ। তিনি বলেন, বিভিন্ন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে পরিবেশ দূষণের অভিযোগ আছে। কিন্তু এই সরকার পরিবেশ দূষণের জন্য একজন বড় ব্যবসায়ীকেও গ্রেপ্তার করেনি। রাস্তায় পানি ছিটিয়ে বায়ুদূষণ কমানো যাবে না। ঢাকাকে আরও আবাসযোগ্য করতে বহুতল ভবনের অনুমোদন, যানবাহন বাড়ায়– এমন প্রকল্প সরকার অনুমোদন দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এটি শুধু মানবদেহেরই ক্ষতি করছে না, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

ঢাকার বায়ুদূষণকে ‘রেড কনসার্ন’ উল্লেখ করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, দূষণ রোধে মন্ত্রণালয় শেষ সামর্থ্যটুকু দিয়ে চেষ্টা করছে। পরিবেশ অধিদপ্তর প্রতিনিয়ত নজরদারি করছে। নির্মাণ উপাদান রাস্তার ওপর রাখলে জরিমানা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে সুইডিশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি (পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন) নায়োকা মার্টিনেজ-ব্যাকস্ট্রম বলেন, বায়ুদূষণ বাংলাদেশের প্রধান শহরগুলোর অন্যতম 
গুরুতর সমস্যা। গণপরিবহন বায়ুদূষণ রোধে ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি গণপরিবহন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহের কথাও জানান।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক মাহবুবুল ইসলাম বলেন, বায়ুদূষণজনিত অসুস্থতায় ভোগা অনেক রোগী পাচ্ছেন তিনি। দূষিত বায়ুর কারণে শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত হয় উল্লেখ করে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের উপপরিচালক আয়েশা আক্তার বলেন, বায়ুদূষণের কারণে তাৎক্ষণিকভাবে হাঁচি-কাশি হয়। তবে এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। বায়ুদূষণ রোধে সরকারের যে নির্দেশনা, তা সরকারি ও বেসরকারি নির্মাণকাজের সময় মানা হচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন সেন্টার ফর ল অ্যান্ড পলিসি অ্যাফেয়ার্সের সেক্রেটারি সৈয়দ মাহবুবুল আলম।

© Samakal
Shares:
Leave a Reply