বিশ্বে মোবাইল মানির ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে, এগিয়ে বাংলাদেশ

বিশ্বে মোবাইল মানির ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে, এগিয়ে বাংলাদেশ

সমৃদ্ধি

সমকাল প্রতিবেদক

2025-01-10

এক সময় কথা বলা এবং বার্তা পাঠানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল মোবাইল ফোনের ব্যবহার। সময়ের বিবর্তনে এবং তার সঙ্গে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের কল্যাণে মোবাইল ফোন বিশ্বব্যাপী আর্থিক লেনদেনের অপরিহার্য মাধ্যম হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী ‘মোবাইল মানি’র ব্যবহার বাড়ছে দ্রুত গতিতে। ২০২৩ সালে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রতি মিনিটে লেনদেন হয়েছে প্রায় ২৭ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩৩ কোটি টাকা। এমন চিত্র উঠে এসেছে ‘দি স্টেট অব দি ইন্ডাস্ট্রি রিপোর্ট অন মোবাইল মানি ২০২৪’ শিরোনামে প্রকাশিত এক রিপোর্টে।
গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস অ্যাসোসিয়েশন, সংক্ষেপে জিএসএমএ রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে। জিএসএমএ লন্ডনভিত্তিক একটি অলাভজনক সংস্থা, যা বিশ্বব্যাপী মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের প্রতিনিধিত্ব করে। জিএসএমএ এই প্রতিবেদন তৈরির জন্য যেসব দেশে জরিপ পরিচালনা করেছে, বাংলাদেশ তার মাঝে অন্যতম।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোবাইল মানি মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মোবাইল মানির ব্যবহার বৃদ্ধি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সরাসরি অবদান রাখছে। ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে জিএসএমএ বলেছে, মোবাইল মানির ১০ শতাংশীয় পয়েন্ট বৃদ্ধি একটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি ০ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারে।
এই বৈশ্বিক চিত্রের প্রতিফলন বাংলাদেশেও রয়েছে। বাংলাদেশে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে। শুধু ক্যাশ ইন বা ক্যাশ আউট বা কাউকে টাকা পাঠানোর মধ্যে এ সেবা সীমাবদ্ধ নেই। মার্চেন্ট পেমেন্ট, বিভিন্ন পরিষেবার বিল ও ফি পরিশোধ, অনুদান, উপবৃত্তির অর্থ বিতরণ, বেতন পরিশোধসহ বিভিন্ন ধরনের পেমেন্ট করা যাচ্ছে এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। এমনকি এমএফএস থেকে ঋণও নেওয়া যাচ্ছে, করা যাচ্ছে সঞ্চয়। আর প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্স পাঠানো আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে সহজ করেছে এমএফএস সেবা।
জিএসএমএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিশ্বে মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবার নিবন্ধিত অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ১৭৫ কোটি, আগের বছরের চেয়ে যা ১২ শতাংশ বেশি। এসব অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ওই বছরে লেনদেন হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলার, যা ২০২২ সালের তুলনায় ১৪ শতাংশ বেশি। ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক জিডিপিতে মোবাইল মানির অবদান ৬০ হাজার কোটি ডলার। এসব কারণে মোবাইল মানি এখন বিশ্বব্যাপী আর্থিক অন্তর্ভুক্তির সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যম। ২০২৩ সালে সারাবিশ্বে নিবন্ধিত এজেন্টের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৮৬ লাখ, যা এক বছর আগের চেয়ে ২২ শতাংশ বেশি।
২০২৩ সালে মোবাইল মানি সেবার মধ্যে আন্তর্জাতিক রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বৈশ্বিক রেমিট্যান্স আগের বছরের ২২ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২৩ সালে ২৯ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। এক বছরে বেড়েছে প্রায় ৩৩ শতাংশ। মার্চেন্ট পেমেন্ট ১৪ শতাংশ বেড়ে ৭৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। প্রতি সক্রিয় হিসাবে গড় লেনদেন হয়েছে ১৬৯ ডলার, যা ২০২২ সালে ছিল ১৬৩ ডলার। ব্যাংক থেকে মোবাইল এবং মোবাইল থেকে ব্যাংকে লেনদেন– দুটোই বেড়েছে। ২০২৩ সালে দুটি মিলিয়ে ২১০ বিলিয়ন ডলারের লেনদেন হয়েছে। আগের বছরের চেয়ে যা ৫০ শতাংশ বেশি। আর ২০২০ সালের তুলনায় তা ২৫০ শতাংশ বেশি।
এমএফএসে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি যেমন
জিএসএমএ ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে আটটি দেশের ওপর ভোক্তা জরিপ করে। জরিপের ফলাফলে বলা হয়, যেসব দেশে ২০২৩ সালে মোবাইল মানি বিষয়ে সচেতনতা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। বাংলাদেশে এ বিষয়ে সচেতন ৮১ শতাংশ পুরুষ এবং ৭২ শতাংশ নারী, যা অনেক দেশের চেয়ে বেশি। জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের মধ্যে ৪৯ শতাংশের মোবাইল মানি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। নারীর ক্ষেত্রে এই হার ২১ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে, ভারত, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার চেয়েও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সামনে আছে শুধু কেনিয়া এবং সেনেগাল।
জিএসএমএ রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় মোবাইল মানি অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল ৪০ কোটি। এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, দেশে ওই সময় নিবন্ধিত এমএফএস গ্রাহক ছিল ২২ কোটি ৪৫ লাখ। অর্থাৎ, দক্ষিণ এশিয়ায় মোট মোবাইল মানি অ্যাকাউন্টের ৫৬ দশমিক ১২ শতাংশই ছিল বাংলাদেশে। আর বৈশ্বিক মোবাইল মানি অ্যাকাউন্টের ১২ দশমিক ৮২ শতাংশ খোলা হয়েছে বাংলাদেশে। দক্ষিণ এশিয়ায় এক বছরে এমএফএস গ্রাহক বেড়েছে ১১ শতাংশ। আর বাংলাদেশে বেড়েছে ১৮ শতাংশ।
বাংলাদেশের বৃহত্তম এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশ এই খাতের বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিতেও অবদান রাখছে। কোনো কোনো প্যারামিটারে বিকাশের প্রবৃদ্ধি বৈশ্বিক গড়ের চেয়েও ভালো করেছে। ২০২৩ সালে বিকাশের মাধ্যমে লেনদেন আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে ২৪ শতাংশ।
২০২৩ শেষে বিকাশের গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ কোটি ৪০ লাখ ৫৪ হাজার, যা আগের বছরের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি। ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২ সালে গ্রাহক সংখ্যা বেড়েছিল যথাক্রমে ৩২ শতাংশ, ১৪ শতাংশ এবং ১৩ শতাংশ। ২০২৩ সাল শেষে বিকাশের এজেন্ট সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লাখ ৬৪ হাজার ১৬৫, যা আগের বছরের চেয়ে ১৩ শতাংশ বেশি। এর আগের বছর ২০২২ সালে এজেন্ট সংখ্যা ২৬ শতাংশ বেড়েছিল, তারও আগে ২০২১ সালে এজেন্ট সংখ্যায় রেকর্ড ২৫৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়।
২০২৩ সালে বিকাশের মার্চেন্ট সংখ্যা ছিল ৭ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪২, যা আগের বছরের চেয়ে ১৭৬ শতাংশ বেশি। আগের বছরগুলোতেও মার্চেন্ট সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি ছিল। যেমন– ২০১৯ সালে বিকাশের মার্চেন্ট ১০৪ শতাংশ বেড়েছিল।
২০২৩ সালে বিকাশের মাধ্যমে দেশে পাঠানো প্রবাসীদের রেমিট্যান্স আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিকাশের মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্স ২০২৩-এর তুলনায় ৬৫ শতাংশ বেড়েছে। শতাধিক আন্তর্জাতিক মানি ট্রান্সফার অর্গানাইজেশন (এমটিও) এবং দেশের শীর্ষ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সঙ্গে নিয়ে প্রবাসীদের জন্য রেমিট্যান্স পাঠানোর একটি শক্তিশালী ইকোসিস্টেম তৈরি করেছে বিকাশ, যার মাধ্যমে ১৪০টিরও বেশি দেশ থেকে প্রিয়জনের বিকাশ অ্যাকাউন্টে সরাসরি রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।

© Samakal
Shares:
Leave a Reply