
শিউলিকথা
কালের খেয়া
মালেকা পারভীন 2024-12-26
১.
“শি রিমেইনড চাইল্ডলেস বাই চয়েস।” পরিচিত একজনের ফেসবুক স্ট্যাটাসের শেষ অনুচ্ছেদের প্রথম লাইন। লাইনটা পড়ে রীতিমতো সজোরে ধাক্কা খেলাম। শেষ অনুচ্ছেদ শেষ না করে আমি আবার প্রথম থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পুরো স্ট্যাটাসটা পড়লাম।
চার অনুচ্ছেদে ১৪৫ শব্দের স্ট্যাটাসটিতে একজন ভদ্রমহিলার কথা বলা হয়েছে। পেশায় তিনি একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠিত ব্যারিস্টার। নানা চড়াই-উতরাই পার করে সমাজে তাঁর অবস্থান প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। বর্তমান সময়ে মিডিয়ার প্রিয় মুখ। টক-ঝাল-মিষ্টি মেশানো নানা টক শোতে তাঁর নিয়মিত ঝলমলে উপস্থিতি কিছুক্ষণের জন্য চোখ ঝলসে দেয়।
বছর কয়েক আগে এক ৮ মার্চ নারী দিবসে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক তাঁর সম্পর্কে প্রথম একটি দীর্ঘ ফিচার প্রকাশ করে। তারপর থেকেই তিনি পাবলিক সেলিব্রিটিতে পরিণত হয়েছেন। তারপর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি একজন ভাইরাল সেনসেশন। এসবই উত্তরাধুনিক প্রযুক্তি যুগের আনঅ্যাভয়েডেবল রিপল এফেক্ট/স্পিল ওভার/পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
যিনি তার ফেসবুক পোস্টে বিখ্যাত ব্যারিস্টার ভদ্রমহিলা সম্পর্কে লিখে বেশ কিছু ডোপামিন নিঃসরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছেন নিজের জন্য, তিনি নিজেও তার কাজের জায়গায় উঁচু স্তরে পৌঁছে গেছেন। নিয়ম করে এসব ভিভিআইপি পোস্ট দিয়ে তিনি তার হাই প্রোফাইল স্ট্যাটাসের মাহাত্ম্য জাহির করে থাকেন। এসব করে আদতে কী ফায়দা হয় বা হবে, আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের রাডারে ধরা পড়ে না। আমি কেবল চুপচাপ দেখে যাই। আমার এই দেখে যাওয়াতেই আনন্দ!
তবে সেদিনের স্ট্যাটাস পড়ার পর কেবল নিশ্চুপ আনন্দ উপভোগের মধ্যেই নিজের প্রতিক্রিয়া সীমাবদ্ধ থাকল না। বরং একেবারেই অচিন্ত্যনীয় এক অদ্ভুত মানসিক তাড়নার শিকার হলাম। দ্রষ্টব্য স্ট্যাটাসের বিশেষ দুয়েকটা শব্দ বা গোটা লাইনটাই আমাকে একঝটকায় তেত্রিশ বছর আগের এক জেলা শহরের কোথাও নিয়ে ছুড়ে ফেলল। বিদ্যুতের গতিতে ছিটকে পড়লাম সেই শহরের মোটামুটি অভিজাত এলাকার এক দোতলা বাড়ির লম্বা বারান্দায়। হলুদ রঙের সাবেকি আমলের বাড়িটির দেয়ালজুড়ে একধরনের বিষন্নতা ঘন মসের মতো লেপটে আছে।
২.
এর আগে আরেক দিন এসেছিলাম বাসাটায়। মধ্য জুনের এক বৃষ্টিস্নাত সকালে। বৃষ্টি গায়ে মেখে সকালটা তখন দুপুরের দিকে গড়াতে শুরু করেছে। যে কারণে ওই বাসায় যাওয়া, তার কোনো কূলকিনারা করতে না পেরে মন-মেজাজ খুব খারাপ হয়েছিল।
সদ্য প্রেমে পড়েছি তখন মুশফিক নামের অগোছালো ছেলেটার। সে অবশ্য কিছুতেই তার প্রায় প্রাক্তনের সর্বনাশা মায়ার জাল ছিঁড়ে বের হয়ে আসতে পারছে না। আলগা হয়ে যাওয়া প্রেমের বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আনার আপ্রাণ যুদ্ধে সে ক্লান্ত বিধ্বস্ত। পরাজিত তরুণ প্রেমিক আপাত শান্তি খোঁজার চেষ্টা করছে সহজলভ্য মাদকের নেশায়।
ঠিক এ রকম টালমাটাল সময় মুশফিকের সাথে আমার আকস্মিক পরিচয়। এখন মনে হয় সেই পরিচয় না হলেই ভালো হতো। সে সময় অবশ্য তার এলোমেলো উদ্ভ্রান্ত আচরণ দেখে ভীষণ দ্রবীভূত হয়েছিল আমার সহজ-সরল হৃদয়। মনে হয়েছিল, কেবল ভালোবাসার কাঙালপনার কারণে এত চমৎকার একটা ছেলের জীবন এভাবে শেষ হয়ে যাবে?
আমার মনে হওয়াটা ভুল ছিল। সে ভুলের হিসাব হয়তো অন্য কোথাও মেলানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। এখানে এখন হলুদ রঙের দোতলা বাড়িটার কোনো এক কোনায় নীরবে নিভৃতে ধুঁকতে থাকা এক শিউলি কাহন। স্বজনদের আরোপিত অনাদরে শুকিয়ে যেতে থাকা এক উজ্জ্বল শিউলি ফুলের চুপচাপ ঝরে যাওয়ার বয়ান।
৩.
মুশফিকের প্রাক্তন তার বড় খালার ছোট মেয়ে বকুল। দ্বিতীয় দিনের মতো বকুলদের বাসায় এসেও তার দেখা মিলল না।
নানা বাহানায় সে ইচ্ছা করেই মুশফিককে এড়িয়ে যাচ্ছে। অথচ মুশফিক বকুলের মুখ থেকে একবার সরাসরি ‘না’ শোনার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। সেই ‘না’ না শুনে সে আমাকে কিছুতেই সবটুকু ‘হ্যাঁ’ বলতে পারছে না! এক বিশ্রী অবস্থা!
বকুলের বড় বোন বেলিপা, যাকে মুশফিক তার ফ্রেন্ড, ফিলোসফার, গাইড এবং মেন্টর জ্ঞান করে, আমাকে আজ তাদের বাসায় নিয়ে যেতে বলেছে। সেই হলুদ রঙের দোতলা বাসায়। সেদিনই এই জটিল সম্পর্কের একটা এসপার-ওসপার করবে বলে বেলিপা শপথ নিয়েছে। অথচ যার জন্য এত অপেক্ষা আর এত জটিলতা, তার কোনো খবর নেই। সে লাপাত্তা লেডি।
প্রথম দিনের মতো আজও আমি দোতলার বারান্দায়। এক কোণে পেতে রাখা গোল টেবিলটার সামনে এক কাঠের চেয়ারে বসে আছি। গালে হাত, চোখে উদ্গ্রীব চাহনি, মনে শঙ্কা-দ্বিধা মেশানো এক চূড়ান্ত অস্বস্তিকর অবস্থা। প্রথম দিনের মতো আজ বৃষ্টি নেই। আছে শেষ আগস্টের চিটচিটে গরমে বিরক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে যাওয়া।
আরও আছে আমজাদ, সেদিন যেমনটা ছিল। আমার আর মুশফিকের সম্পর্ক যেন কোনোভাবে শুরুতেই শেষ না হয়ে যায় সেজন্য সে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বেলিপার সাথে সাথে সেও আমাদের দুজনার মধ্যে দূতিয়ালির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
যে কোনো অজুহাতে হলুদ রঙের বাসাটায় ঢুকে পড়ার জন্য আমজাদ অধীর হয়ে থাকে। কারণ আছে অবশ্য। মুশফিক যখন তাকে জানিয়েছে, আজ আমাকে নিয়ে সে এখানে আসবে, আমজাদ তার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে এক সেকেন্ড দেরি করেনি। কতদিন শিউলির সাথে তার দেখা হয় না, কথা হয় না। সে হাসপাতাল থেকে ফিরেছে কিনা সে খবরও তার জানা নেই। মেয়েটাকে তার পরিবারের লোকজন, নিজের ভাইবোনই মনে হয় মানসিক অত্যচার করে মেরে ফেলবে।
অথচ তার দোষ কী? তার একমাত্র দোষ অন্য ভাইবোনদের মতো তার গায়ের চামড়ার রং সাদা নয়। মানে যাকে ফর্সা চেহারা বলা হয়, জন্মানোর সময় অজ্ঞাত কারণে সেটি সাথে করে না নিয়ে পৃথিবীতে তার দুঃখজনক আবির্ভাব ঘটেছে। এভাবে অপ্রত্যাশিতভাবে জন্ম নিয়ে সে যেন মহাভারত অশুদ্ধ করে ফেলেছে। “জন্মই আমার আজন্ম পাপ” তার ললাটে টিপ চিহ্নের মতো সেঁটে গেছে সেদিনই!
একটু বড় হতে হতে তার টিকোলো নাক, পটোলচেরা চোখ, স্মিতা পাতিলের মুখের ছাঁচ, বাম গালে টোল পড়া মিষ্টি হাসির ঢেউ– কোনো কিছুই শিউলিকে পূর্ণাঙ্গ সুন্দরী হিসেবে গোনায় ধরার জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হয়নি। তার এ সমস্ত থাকা গায়ের শ্যামলা রঙের চাদরে ঢাকা পড়ে গেছে বেমালুম। “সবকিছুই ঠিক আছে, কেবল গায়ের রংটাই যা ময়লা–” তাকে পরিচয় করিয়ে দিতে বা চেনাতে এই অভিধা প্রযোজ্য হয়ে গেল সব সময়ের জন্য!
সকাল-বিকাল গায়ের ময়লা রঙের অপবাদ নিয়ে শিউলিকে দিন পার করতে হয়। শ্যামলা বরণ ধারণ করে শিউলি তাই আর তথাকথিত সুন্দরীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য হতে পারে না। বাঙ্গাল সমাজ কর্তৃক সুন্দরী মেয়ে/কিশোরী/তরুণীর সংজ্ঞা বেঁধে দেওয়ার সময় গায়ের চামড়া সাদা হওয়ার যে আবশ্যক শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়, তা পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় শিউলির কপালে সুন্দরীর তকমা জোটে না।
“কালো? তা সে যতই কালো হোক/দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ” বলে কবিগুরু যতই শ্যামা মেয়ের বন্দনায় ব্যাকুল হন না কেন, শিউলির হৃদয় আকাশে কেবল কালো কাজল মেঘের ঘনঘটা– তার মনের ঈশান কোণে শুধু কালো কোমল ছায়ার আনাগোনা! ব্ল্যাক বিউটির মতো মুখভারী শব্দ চয়নগুলো তাই পত্রিকার পাতায় মানায়, অন্দরমহলের অভিধানে সেগুলোর কোনো স্থান নেই, ময়লাবত পরিত্যাজ্য!”
৪.
শিউলি সম্পর্কে এসব কিছুর সাথে বেলিপা-বকুলসহ তাদের পরিবারের ভেতরের আরও কিছু কাহিনি শোনার সুযোগ বা দুর্ভাগ্য হয়েছিল আমার আমজাদের কল্যাণে। আমজাদ মুশফিকের ফুফাতো ভাই আর বেলিপা-শিউলি-বকুলের চাচাতো ভাই। কাজিনদের এ রকম আপাত সরল কিন্তু কার্যত জটিল পারিবারিক সম্পর্কজাত সমীকরণের মধ্যে ঢুকে পড়ে প্রথমদিকে আমার একধরনের দিশেহারা অবস্থা হয়েছিল। তার ওপর সিদ্ধান্তহীনতার চোরাবালিতে মুশফিকের ক্রমাগত তলিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে অসহায় বোধ করছিলাম।
আমার বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে আমজাদ এগিয়ে আসে খানিকটা সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে। সেটা কতটুকু সান্ত্বনা ছিল আর কতটুকু অন্যের কষ্ট দেখে নিজের কষ্ট ভুলে থাকার বৃথা চেষ্টা ছিল, তা আর পরীক্ষা করার সময় হয়নি। তবে আমজাদের বলা কথাগুলো একেবারে উপেক্ষা করতে পারিনি। আমারই সমবয়সী একটা মেয়ে এক উদ্ভট সামাজিক অনাচারের শিকার হয়ে ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছে মেনে নিতে অসুবিধা হয়েছিল। একই সাথে শিউলির জন্য কিছুই করতে না পারার অক্ষমতা মানসিকভাবে অস্বস্তিতে রেখেছে বহু দিন।
শিউলির প্রেমে পড়েছিল আমজাদ। ভীষণ রকম। কিশোর বয়সের রবিন হুড টাইপের প্রেম। যে প্রেম হাজারটা বাধা পেরিয়ে বন্দি রাজকন্যাকে মুক্ত করে নিজের কাছে আনতে চায়, তবে কোনোবারই সফল হতে পারে না। চারপাশের অন্ধকারের মধ্যে আমজাদের অযাচিত প্রেমের আহ্বানে শিউলিও হয়তো কিছুটা প্রশ্রয় দিয়েছিল। কিন্তু সম্পর্কটা পূর্ণতা পাওয়ার আগেই তাকে হাসপাতালে মনোবিদের কাউন্সেলিং নিতে ভর্তি হতে হয়েছে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিল শিউলি।
৫.
“তুমি বিশ্বাস করবে না শুনলে। আমার বড় চাচার পরিবারের প্রায় প্রত্যেকে একেকটা অমানুষ। তাদের নিজেদের মেয়ে-বোন। অথচ গায়ের রং একটু চাপা বলে দিনের পর দিন তাকে খোঁটা শুনতে হয়েছে। সেই একেবারে ছোটবেলা থেকে। একটা বাচ্চা মেয়ে যদি তার ভাই-বোনের কাছ থেকে সারাক্ষণ একই রকম দুর্ব্যবহার পেতে থাকে, বাইরের লোকজনের সামনে তাকে আসতে নিষেধ করে বা এলেও অপমান করে সরিয়ে দেয়, এগুলো কীভাবে সেই মেয়েটার ওপর প্রভাব ফেলে, তুমি অনুমান করতে পারো?”
না, আমি অনুমান করতে পারিনি। আমার চেনাজানা জগতে এ ধরনের আচরণের সাথে পরিচয় ঘটেনি বলে আমার পক্ষে ওই রকম অস্বাভাবিক অবস্থা কল্পনার মানসচক্ষেও অনুমান করে ওঠা সম্ভব হয়নি।
“অথচ অন্যদের তুলনায় বেশি মেধাবী ছিল সে। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেল। কোথায় সবাই তাকে নিয়ে আনন্দ করবে, আরও ভালো করার জন্য উৎসাহ দেবে, না তার কপালে জুটল কেবল শ্লেষমার্কা কথাবার্তা। তাদের এসব আচরণের কোনো কার্যকারণ আমি খুঁজে পাইনি। তুমিও পাবে না। গায়ের রং সাদা না হলেই কি নিজের রক্তের সম্পর্কের একজনের সাথে এমন আচরণ করা যায়? তাকে এভাবে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করতে হয়? মাঝে মাঝে লুকিয়ে ছাপিয়ে শিউলির সাথে কথা বলার সুযোগ হলে সে বলত, আমার কী মনে হয়, জানো আমজাদ? আমি মনে হয় এই পরিবারের কেউ না!”
আমজাদের মুখে শিউলির বুকচাপা আর্তনাদের কথা শুনে মনে মনে চমকে উঠি। খুব মায়া হয় মেয়েটার জন্য। একবার কথা বলে দেখতে ইচ্ছা করে, যদি কিছু করতে পারতাম! আমজাদকে কথাটা বলাতে তার সরু চোখ দুটো চিকচিক করে ওঠে। মায়া হয় বেচারার জন্যও। বেলিপা-বকুলদের বাসায় আমজাদের প্রবেশ করার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আছে। শিউলির জন্য তার ছটফটানি ওই পরিবারের সদস্যরা ভালো চোখে দেখে না।
“আরও খারাপ লাগে কী জানো, শিউলির ব্যাপারে বড় চাচা-চাচির নির্লিপ্ত আচরণ। তাদের নিজেদের সন্তান। অথচ দিনের পর দিন মেয়েটা এ রকম পারিবারিক অবহেলার শিকার হয়ে যাচ্ছে তার নিজের ভাইবোনদের কাছে পিতামাতা হিসেবে এটা তারা কীভাবে মেনে নিচ্ছেন একদমই মাথায় ঢোকে না আমার। বড় চাচির মাথায় একটু সমস্যা আছে। তারটা না হয় মানা গেল। বড় চাচা কেন বিষয়টা শুরু থেকে সিরিয়াসলি নিলেন না, সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর পাই না।”
বলতে বলতে আমজাদের গলা ধরে আসে। আমার চুপচাপ শুনে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। মুশফিক আমাকে আমজাদের সাথে বসিয়ে দিয়ে অনেকক্ষণ লাপাত্তা হয়ে গেছে। অনুমান করি, বাসার নিচতলায় কোনো রুমে বসে তার প্রাক্তন বকুলের সাথে বোঝাপড়ার চেষ্টা করছে। করুক, আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই এই অভিশপ্ত বাসা থেকে বের হবো। মনে মনে ফুঁসতে থাকি আমি।
৬.
আমজাদের কাছ থেকে শিউলির জীবনযন্ত্রণার গল্প শুনে বেশ খানিকটা মুষড়ে পড়ি। অবশ্য বাহ্যিক কোনো আচরণে বা অভিব্যক্তিতে যেন তা প্রকাশ না হয়ে পড়ে সে ব্যাপারে সজাগ থাকার চেষ্টা করি। আমার নিজের জীবনে অন্য ধরনের কষ্ট আছে। সেটার সাথে মিলিয়ে দেখে মনে হয়, আমি শিউলির চেয়ে হয়তো ভালো অবস্থায় আছি।
একই পরিবারের সন্তানদের মধ্যে বিভেদমূলক আচরণ করলে তার ফল এমনই দাঁড়ায়। মুশফিকের আগের প্রেমিকা বকুল, শিউলির ছোট বোন দেখতে সুন্দরী বলে পরিবারে তার অতিরিক্ত আহ্লাদ। বয়সে সে অনেক ছোট, অথচ তার চালচলন বেপরোয়া। সুন্দর মুখের জাদুতে নানারকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে পটীয়সী। এসব নিয়ে পাড়ার লোকজন মুখরোচক গল্প ছড়ায়, বদনাম করে। তাতে তার পরিবারে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। বকুলকে কেউ শোধরানোর কথা চিন্তা করে না।
অন্তত আমজাদ সেটাই মনে করে। অথচ তাদের যত হম্বিতম্বি সব শিউলির সাথে।
“বুঝলে, কোনো দিন যদি সুযোগ পাই, শিউলিকে এই বাসা থেকে বের করে নিয়ে যাব। একদিন না একদিন যাবই। এই যে দেখো বকুল মুশফিকের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে, এই পরিবারের সবাই কিন্তু বিষয়টা জানে। কিন্তু এক বেলিপা ছাড়া সেটা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। আর এদিকে আমার সাথে শিউলিকে দেখা করতেই দেবে না। কোনো মানে হয় এসবের?”
আমজাদ গজরাতে থাকে। আমি মাথা ঘুরিয়ে আরেক দিকে তাকাই। লম্বা বারান্দার একপাশ জুড়ে নানারকম ক্যাকটাসের টব সাজানো। হ্যাঁ, এই বাড়িতে ক্যাকটাসই মানায়! এ রকম মনে হতে থাকে। আর মুশফিকের দীর্ঘ অনুপস্থিতি একসময় আমার মধ্যে একধরনের বৈরাগ্যের জন্ম দেয়। যাক, যা খুশি করুক– এ রকম স্টয়িক সাবমিশন!
৭.
ঝিম ধরা নিস্তব্ধতার মধ্যে হঠাৎ আমজাদের গলা খাঁকারি শুনতে পাই। মুশফিকের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকতে থাকতে একসময় টেবিলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। আমজাদ আমাদের দুজনের জন্য কোথা থেকে দুই কাপ চা জোগাড় করে এনেছে। চোখ খুলে সামনে চায়ের কাপ দেখে মন ভালো হয়ে গেল।
“আজ তোমাকে অনেক কথা বলে ফেলেছি। কাউকে কাউকে না তো এসব বলতে হয়, তাই না?”
আমজাদের কথাবার্তায় একধরনের দার্শনিক টোন আছে। মাঝে মাঝে শুনতে ভালোই লাগে। সব সময় না অবশ্য। একঘেয়ে জীবনে দর্শনের উচ্চকিত বাণী কখনও কখনও ক্ষত সারানো মলমের কাজ করে বটে, তবে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে তার আবেদনের ক্ষেত্রে তারতম্য ঘটে।
“তোমাকে শিউলির আরেকটা কথা বলে আজকের মতো থেমে যাব। মাঝে মাঝে মেয়েটা অদ্ভুত সব কথা বলে। যদিও আজ পর্যন্ত আমাকে বলেনি যে সে সত্যিই আমাকে ভালোবাসে কিনা। কিন্তু একদিন হঠাৎ আমার হাত ধরে বলে বসে, আমজাদ, আমার যদি কোনোদিন বিয়ে হয়, আমি কখনও বাচ্চা নেব না। মানে, বুঝতে পেরেছ? যে আমার স্বামী হবে, আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সে আমাকে কখনও মা বানাতে পারবে না! এসব জানার পর কি কেউ আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে? তুমি রাজি হবে? সেদিন আমি শিউলির কথার কোনো জবাব দিতে পারিনি। তারপর তার সাথে আমার আর দেখাও হয়নি। নিজের ওপর পরিবারের অন্যায় অত্যাচার মেনে নিতে পারেনি বলেই মেয়েটা এ রকম অস্বাভাবিক চিন্তাভাবনা করতে বাধ্য হয়েছে। আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তাকে কিছু বুঝিয়ে বলার সুযোগ পাইনি তারপর থেকে।”
৮.
তিন দশকের ব্যবধানে শোনা “চাইল্ডলেস বাই চয়েস” কথাটা কেন জানি আমাকে শিউলির কথা মনে করিয়ে দিল। মুশফিকের সাথে আমার সম্পর্ক শুরুতেই শেষ হয়ে গেছে। বেলিপা-আমজাদের যৌথ উদ্যোগ কোনো কাজে আসেনি। বকুল তার নতুন প্রেমিকের সাথে সংসার পেতেছে। আমজাদ অন্য কাউকে বিয়ে করে সংসার যাপন করছে। কেবল শিউলির কোনো খবর আমাকে আর কেউ দিতে পারেনি।