সাংঘর্ষিক রাজনীতির অবসানে যা জরুরি

সাংঘর্ষিক রাজনীতির অবসানে যা জরুরি

মতামত

সাইফুর রহমান তপন

<time class="op-modified" dateTime="2024-12-26"2024-12-26
2024-12-26

দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ‘সমমনা’ দলগুলোর সঙ্গে শনিবার থেকে আবারও বৈঠক শুরু করেছে। দলটির পক্ষ থেকে দেওয়া আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে বলা হচ্ছে, ‘দেশের চলমান রাজনৈতিক ও বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করে পরবর্তী করণীয়’ নির্ধারণ। তবে বৈঠকের আসল উদ্দেশ্য যে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ তৈরি– তা আমজনতাও বোঝে। ফলে প্রতিটি বৈঠকেই প্রাধান্য পাচ্ছে দ্রুত নির্বাচন কেন প্রয়োজন, তা নিয়ে আলোচনা। সোমবার রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এনডিএম নেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকও ব্যতিক্রম ছিল না। 

তবে ওই বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী দ্রুত নির্বাচনের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে এমন কিছু কথা বলেছেন, যেগুলো বিশেষ মনোযোগ দাবি করে। তিনি বলেছেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে উদার গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে চাই। অনেক সংঘর্ষ হয়েছে; দেশের মানুষ অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই সাংঘর্ষিক রাজনীতি যেন বাংলাদেশে আর কোনোদিন ফিরে না আসে, আমরা সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। সেটা সফল হবে একমাত্র দ্রুত একটা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।’ (বাংলা ট্রিবিউন, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪) আমীর খসরু শুধু বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নন, অন্তত গত ১৫ বছরের বিএনপি ও তার মিত্রদের আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলা যায়, দলটির নীতিনির্ধারণেও তাঁর ভূমিকা অনেক। সে হিসেবে বলা যায়, সাংঘর্ষিক রাজনীতির অবসান শুধু আমীর খসরুরই চাওয়া নয়, তাঁর দলও তেমনটা প্রত্যাশা করে।

স্মরণ করা যেতে পারে, গত ১২ নভেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের এক আলোচনা সভায় আমীর খসরু বলেছিলেন, ‘অন্য কোনোভাবে আওয়ামী লীগকে যদি বাতিল বা নিষিদ্ধ চান, সেগুলো টিকবে না। আওয়ামী লীগকে বাতিল করতে হবে জনগণের ভোটের মাধ্যমে’ (সমকাল)। তাঁর বক্তব্যটি সোমবারের বক্তব্যের সঙ্গে খুব নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত বললে ভুল হবে না। যদিও সোমবারের বক্তব্যে কার সঙ্গে কার সাংঘর্ষিক রাজনীতি, তা তিনি স্পষ্ট করেননি, তবে রাজনীতি সচেতন মহলের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়– তিনি আমাদের রাজনীতির দুই প্রধান খেলোয়াড় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার চিরাচরিত সাংঘর্ষিক সম্পর্কেরই অবসান চেয়েছেন। 

অস্বীকারের উপায় নেই, আওয়ামী লীগের পুরো নেতৃত্ব ৫ আগস্ট থেকে পালিয়ে বা আত্মগোপনে থাকলেও, এখনও দেশের রাজনীতি চলছে আওয়ামী লীগেরই তৈরি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ সূত্র মেনে। আর বিস্ময়কর শোনালেও সত্য, এ ক্ষেত্রে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব দানকারী শিক্ষার্থীরাসহ আওয়ামীবিরোধী শক্তিগুলোরই ভূমিকা প্রধান। আওয়ামী লীগ বরাবরই নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি বলে আসছে; আর তার প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি ও তার মিত্রদের সম্পর্কে বলছে তারা জামায়াতে ইসলামীর মতোই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি। গণঅভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা এই বিভাজনের রাজনীতি মুছে দেওয়ার অঙ্গীকার করলেও অহোরাত্রি ‘মুজিববাদ’বিরোধী নানা বুলি আওড়াতে গিয়ে বাস্তবে ওই বিভাজনকেই আরও দৃঢ় ভিত্তি দিচ্ছেন। আবার বিএনপি, জামায়াতসহ দল দুটোর মিত্ররাও প্রায় একই পথে হাঁটছে।
মোদ্দা কথা, অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়োগকর্তা বলে যারা খোদ প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকেই স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এই ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বিএনপিসহ এ সময়ে যারা রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাদের মধ্যে বড় কোনো আদর্শিক ফারাক নেই। অতএব তাদের মধ্যে আর যা-ই হোক, সাংঘর্ষিক সম্পর্ক থাকতে পারে না। আমীর খসরু বিশেষত ১৯৭৫ সালের বিয়োগান্ত প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার সাংঘর্ষিক রাজনীতিরই অবসান চেয়েছেন। বাস্তবে গণঅভ্যুত্থানের ধাক্কায় দলের কাঠামো ভেঙে পড়লেও আওয়ামী লীগের কয়েক কোটি কর্মী-সমর্থক তো আর নাই হয়ে যায়নি। ছাত্রনেতারা নতুন দল গঠনের তোড়জোড় চালাচ্ছেন বটে, কিন্তু তাদের তৎপরতা ও কথাবার্তায় এটা স্পষ্ট– অন্তত আওয়ামী লীগের সেই সব কর্মী-সমর্থকের আত্তীকরণ তাদের লক্ষ্য নয়। ফলে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়ানোর পরিস্থিতি রয়েই যাচ্ছে। এই সম্ভাবনা ৫৩ বছরের মধ্যে অন্তত দেড় দশক দেশ শাসনকারী বিএনপি নেতাদের ভালোই বোঝার কথা। সম্ভবত এ কারণেই বিএনপি দলটিকে নির্বাচনেরও বাইরে রাখতে চায় না।

প্রসঙ্গত, গত ১৯ নভেম্বর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ভারতীয় পত্রিকা ‘দ্য হিন্দু’কে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার এক সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ প্রকাশিত হয়। সেখানে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘আমরা রাজনৈতিক দল সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে চাইনি এবং বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) বলেছে, সব রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। তাই তারা ইতোমধ্যে তাদের রায় দিয়েছে এবং আমরা দেশের একটি বড় দলের মতামতকে অস্বীকার করতে পারি না।’ (সমকাল)
এখন আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনার পাশাপাশি যদি সাংঘর্ষিক রাজনীতিরও অবসান ঘটাতে হয়, তা কি কেবল একটা সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করলেই হবে? সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ‘চিরস্থায়ী’ করলেও কি রাজনীতিতে দুই প্রধান দলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব?
অভিজ্ঞতা বলে, অতি আশাবাদীও এ ক্ষেত্রে এক পর্যায়ে হতাশ হতে বাধ্য।

মনে রাখতে হবে, দেশে সাংঘর্ষিক রাজনীতি না থাকলে নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারও প্রয়োজন পড়বে না। বহুল কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ও অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হয় দেখেও দুই দলের নেতারা দশকের পর দশক সাংঘর্ষিক রাজনীতি চালিয়ে গেছেন। এমনকি ২০০৭-০৮ সালের ওয়ান-ইলেভেনের ছদ্মবেশী সামরিক শাসনও তাদের এ বিষয়ে কোনো বোধোদয় ঘটাতে পারেনি।
বলা হতে পারে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর নিপীড়ন চালানোর ফল দিনশেষে কী দাঁড়ায়, সে সম্পর্কে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বোধোদয় ঘটলেই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে পারে। কিন্তু বিশেষত ১৯৯০-পরবর্তী রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ভিন্ন কথা বলে। প্রতিপক্ষ বা ভিন্নমতের দলন বরাবরই এ দেশে ছিল, যদিও বিগত দেড় দশকে তা চরমে পৌঁছেছিল। অর্থাৎ সাংঘর্ষিক রাজনীতির অবসান চাইলে সব পক্ষকেই কমবেশি শুভবুদ্ধির পরিচয় দিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে শুধু এটুকু বলাই হয়তো যথেষ্ট যে, বিগত সরকারের আমলে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড বা অন্য কোনো গুরুতর অপরাধের শাস্তি স্বচ্ছ তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু যেভাবে দলটির প্রতি ন্যূনতম সহানুভূতি দেখানো মানুষদেরও মামলা-হামলার মাধ্যমে হেনস্তা করা হচ্ছে, তা প্রতিহিংসার রাজনীতিতে নতুন অক্সিজেন জোগায়। যে আইনের শাসন একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি, তাও তো এক প্রকার কষ্টকল্পনা হয়ে দাঁড়ায় এ পরিস্থিতিতে।

সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল

© Samakal
Shares:
Leave a Reply